পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪১৭
উদ্ধার পর্ব্ব—ঊনত্রিংশ প্রবাহ

 এজিদ আর এক পাত্র লইলেন। আবার কোন্ চিন্তায় তিনি মজিলেন, কে বলিবে? তাঁহার মুখে কথা নাই—নীরব। অগ্নির দাহনকারিতা, জলের শীতলত্ব, প্রস্তরের কাঠিন্য, আর মদের মাদকতা কোথায় যাইবে। আয় সাধ্যাতীত হইলে সুরাও মহাবিষ!

 মায়মুনা ও জাএদার নিকট এজিদের অঙ্গীকার পূর্ণ করিবার পর্ব্বোপলক্ষে পাঠকগণ এজিদের সুরাপান দেখিয়াছেন। সে সময়ে এজিদের চক্ষে জল পড়িয়াছিল, এখন এজিদের চক্ষে জল নাই। তাঁহার বিশাল বিস্ফারিত যুগলচক্ষে এখন আর জল নাই। কিছু যে না আছে, তাহা নহে;—তরলতায় বেশী প্রভেদ, বোধ হয়, নাও থাকিতে পারে, কিন্তু বর্ণে একেবারে বিপরীত—টক্‌টকে লাল-জবাফুলও পরাস্ত। সেইজন্যই এজিদের চক্ষে জল নাই। যদি কিছু পড়িবার হয়, যদি এজিদের অক্ষিদ্বয় হইতে এইক্ষণে কিছু পড়িবার থাকে, তবে কি পড়িবে? সে রক্তজবা সদৃশ লাল চক্ষু হইতে এইক্ষণে কি পড়িবে? না, না, না, সে জল নহে। যে দুই এক ফোঁটা পড়িবে, সে দুই এক ফোঁটা জল নহে—জল হইবার কথা নহে। মর্ম্মাঘাতে আহত-স্থানের বিকৃত শোণিতধারা, মর্ম্মাঘাতে ক্ষতস্থানের রক্তের ধারা, দুই চক্ষু ফাটিয়া পড়িবে। জগৎ দেখিবে —এজিদের চক্ষে জল পড়ে নাই। এজিদ ও দেখিবে, তাহার চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হয় নাই। —সে বিশাল নেত্রযুগল হইতে আজ জলধারা প্রবাহিত হয় নাই। হৃদয়ের বিকৃত শোণিতধারা চক্ষুদ্বারে বহির্গত হইয়া, সে পাপ-তাপ অংশের তেজ কিঞ্চিৎ পরিমাণ হ্রাস বোধ জন্মাইবার জন্যই যদি পড়িতে হয়, দুই এক ফোঁটা পড়িবে। বিশাল বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয় ঘোর রক্তিমবর্ণ ধারণ করিয়াছে, তেজ ফুটিয়া বাহির হইতেছে, চক্ষু-তারা লোহিত সাগরে হাবুডুবু খাইতেছে। আজ অপাত্রের হস্তে পাত্র উঠিয়াছে। সুর-প্রিয় অনন্তসুধা মূর্খ-হস্তে পড়িয়া মহাবিষে পরিণত হওয়ার উপক্রম হইয়াছে। আবার পেয়ালা পূর্ণ হইল। চক্ষের পলকে চক্ষুদ্বয় আরও লোহিত হইল। মস্তক অপেক্ষাকৃত ভারী, পদদ্বয় বেঠিক। মানসিক ভাব বিলীন,—পশুভাব জাগ্রত। বাক্‌শক্তির বৃদ্ধি, কিন্তু অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক ও অসঙ্গতভাবেই পূর্ণ— মনে মুখে এক।