পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৫৯
এজিদ বধ পর্ব্ব—দ্বিতীয় প্রবাহ

দিন—পরীক্ষার দিন। সহজে নির্ব্বাচন করিবার এই-ই উপযুক্ত সময় ও অবসর।

 বিজয় ঘোষণা এবং বিজয় বাজনার তুমুলরবে নগরবাসীরা ভয়ে অস্থির হইল। কেহ পলাইবার চেষ্টা করিল,—পারিল না। কেহ যথাসর্ব্বস্ব ছাড়িয়া জাতি-ধন-মন-প্রাণ বিনাশ-ভয়ে দীন-দরিদ্র-বশে গৃহ হইতে বহির্গত হইল। কেহ ফকির-দরবেশ, কেহ বা সন্ন্যাসী-রূপ ধারণ করিয়া জন্মভূমির মায়া পরিত্যাগ করিল। কেহ আনন্দবেগ সম্বরণে অপারগ হইয়া “জয় জয়নাল আবেদীন!” মুখে উচ্চারণ করিতে করিতে জাতীয় সম্ভাষণ, জাতীয় ভাব প্রকাশ করিয়া গাজী রহ্‌মানের দলে মিশিয়া চিরশত্রু-বিনাশের বিশেষ সুবিধা করিয়া লইল। কাহারও মনে দারুণ আঘাত লাগিল,—“জয় জয়নাল আবেদীন!” কথাগুলি বিশাল, শেলসম তাহার অন্তরে বিঁধিতে লাগিল, কর্ণেও বাজিল। কাহারও সাধ্য নাই।—নগর রক্ষার কোন উপায়ই নাই। রাজ-বলের কোন লক্ষণও নাই। আর উপায় কি?—পলাইয়া প্রাণরক্ষা করাই কর্ত্তব্য, তাই অনেকেই যথাসাধ্য পলায়নের উপায় দেখিতে লাগিল। যাহারা জয়নাল আবেদীনের দলে মিশিল না, তাহাদের ভাগ্যে যাহা হইবার হইতে লাগিল। বিপক্ষ দলের জাতক্রোধে এবং সৈন্যদলের অন্তরের মহারোষে অধিবাসীরা যন্ত্রণার একশেষ ভোগ করিতে লাগিল। সন্তানসন্ততি লইয়া ত্রস্তপদে যাহারা পলাইতে পারিয়াছিল, বা প্রকাশ্য পথ ছাড়িয়া গুপ্ত পথে, কোন গুপ্তস্থানে লুকাইয়া আত্মগোপন করিয়াছিল, তাহারাই রক্ষা পাইল, তাহারাই বাঁচিল। বাড়ীঘরের মায়া ছাড়িতে, জন্মের মত জন্মভূমি হইতে বিদায় লইতে যাহাদের একটু বিলম্ব হইল, তাহাদের প্রাণবায়ু মুহূর্ত্তমধ্যে অনন্ত আকাশে—শূন্যে উড়িয়া গেল। কিন্তু জন্মভূমির মায়াবশে তাহাদের দেহ দামেস্কেই পড়িয়া রহিল। কা’র অন্তেষ্টিক্রিয়া কে করে? কার কান্না কে কাঁদে। সুন্দর সুন্দর বাস-ভবন সকল ভূমিসাৎ হইতেছে; ধনরত্ন, গৃহসামগ্রী হস্তে হস্তে চক্ষের পলকে উড়িয়া যাইতেছে। কে কথা রাখে, আর কেইবা কথা শুনে? কোথাও ধূ ধূ করিয়া অগ্নি জ্বলিয়া উঠিতেছে, দেখিতে দেখিতে সজ্জিত গৃহসকল জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইতেছে। নগরময় হাহাকার! নগরময়