ছুটাইয়া ফকির-বেশধারীর নিকটে যাইয়াই দেখি যে, আমাদের গুপ্তচর ওস্মান, —তাহার গলায় তস্বীহ্, হাতে আশা, গায়ে সবুজ পিরহান। দেখা হইবামাত্রই আমাদের পরিচয়, আদর, আহ্লাদ, সম্ভাষণ! তাহারই মুখে শুনিলাম, “মহারাজাধিরাজ মোহাম্মদ হানিফা মদিনাধিপতির সহিত দামেস্ক-নগরে প্রবেশ করেন নাই। ঘোর যুদ্ধের সময়েই তিনি এজিদের সন্ধান করেন। যুদ্ধজয়ের পরক্ষণেই এজিদ তাঁহার চক্ষে পড়ে। এজিদের চক্ষুও চঞ্চল; পশ্চাৎ চাহিতেই তিনি দেখেন যে, সে মহাবীর হানিফার বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয় হইতে ঘোর রক্তবর্ণের তেজ সহস্র শিখায় বহির্গত হইতেছে; তাঁহার ঘোড়াটিও রক্তমাখা হইয়া এক প্রকার নূতন বর্ণ ধারণ করিয়াছে। তাঁহার বাম হস্তে—অশ্বের বল্গা, দক্ষিণ হস্তে—বিদ্যুৎ-আভা-সংযুক্ত রক্তমাখা সুদীর্ঘ তরবারি, মুখে ‘কৈ এজিদ! কৈ এজিদ!” রব। এজিদ আপন নাম শুনিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিয়াই বুঝিলেন,—আর রক্ষা নাই, এক্ষণে পলায়নই শ্রেয়ঃ। যেমনি দেখা, অমনি যুক্তি—পলায়নই শ্রেয়ঃ। এজিদ তখনি অশ্বে কশাঘাত করিলেন—অশ্ব ছুটিল। মহারাজ হানিফাও এজিদের পাশ্চাৎ পশ্চাৎ সিংহ বিক্রমে দুল্দুল্ ছুটাইলেন। দেখিতে দেখিতে তিনি দামেস্ক-প্রান্ত অতিক্রম করিয়া প্রান্তরের পশ্চিম দিক পর্ব্বতশ্রেণীর নিকটস্থ হইলেন। পশ্চাৎ দিক হইতে তীর মারিলেই এজিদের জীবন-লীলা ঐ স্থানেই শেষ হইত। মহারাজ হানিফা একবার এজিদের এত নিকটবর্ত্তী হইয়াছিলেন যে, অসির আঘাত করিলে এজিদ শির তখনই ভূতলে লুণ্ঠিত হইত। পশ্চাৎ দিক হইতে এজিদকে কোন অস্ত্রাঘাত করিবেন না, সম্মুখ হইতেই আক্রমণ করিবেন,—এই আশাতেই বোধ হয়, মহাবেগে তিনি ঘোড়া ছুটাইলেন। কিন্তু এজিদও এমনভাবে অশ্ব চালাইলেন যে, কিছুতেই মহারাজকে তাঁহার অগ্রে যাইতে দিলেন না। দেখিতে দেখিতে আর দেখা গেল না। প্রথমতঃ, অশ্বের অন্তর্দ্ধান, শেষে আরোহীদ্বয়ের মস্তক পর্য্যন্ত চক্ষের অগোচর। আর কোনও সন্ধান নাই। কয়েকজন আম্বাজী অশ্বারোহী সৈন্য মহারাজ হানিফার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল, কিন্তু তাহারা অনেক পশ্চাতে পড়িয়া রহিল। এই শেষ সংবাদ।”
পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্রফ হোসেন.pdf/৪৮৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬৫
এজিদ বধ পর্ব্ব—দ্বিতীয় প্রবাহ