পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৭৭
এজিদ বধ পর্ব্ব-তৃতীয় প্রবাহ

হইল। কিন্তু সংসারচরে আবর্ত্তে পড়িয়া, সপত্নী-মনোবাদ জনিত হিংসা-আগুনে জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক হইতে হইল। তাহাতেই বুঝিলাম: জগতে সুখ কোথাও নাই। দৈহিক জীবনে মনের সুখ কোন স্থানেই নাই। রাজা, প্রজা, ধনী, নির্ধন, দুঃখী, ভিখারী, মহামানী, মহামহিম, বীরকেশরী আন্তরিক সুখ সম্বন্ধে সকলেই সমান—রাজরাণী, ভিখারিণী, ধনীর সহধর্ম্মিণী, দুঃখিনীর নন্দিনী সকলেরই মনের সুখ সমতুল্য। প্রাণে আঘাত লাগিলে মুখ বন্ধ থাকে না। পবিত্রপুরী মধ্যে থাকিয়া এই হতভাগিনী—সপত্নীবাদেই সমধিক মনোবেদনা ভোগ করিয়াছে। সপত্নী সহ একত্র বাস—এক প্রকার জীয়ন্তে নরক-ভোগ! আমি কিন্তু প্রকাশ্যে ছিলাম ভাল। কারণ, যেখানে প্রভুর আদর—সেখানে অন্যের অনাদরে দুঃখ কি? সপত্নীবাদেও রহস্য আছে।— যেখানে সপত্নীবাদ, সেইখানেই শুনা যায়—স্বামীর চক্ষে কনিষ্ঠা স্ত্রীই আদরের ও পরম রূপবতী। পূর্ব্বে জাএদার ভাগ্যাকাশে যে যে প্রকাৱে স্বামীর ভালবাসার তারকারাজি ফুটিয়া চমকিয়াছিল,আমার ভাগ্যবিমানেও তাহাই ঘটিল।—আমিই যখন কনিষ্ঠা স্ত্রী, স্বামীর ভালবাসায় আমিই সম্পূর্ণ অধিকারিণী—সাধারণ মতে আমিই স্বামীর হৃদয়, অন্তর, প্রাণ ষোল আনা অধিকার করিয়া বসিয়াছি।—এই কারণেই আমি জাএদার চক্ষের বিষ! এই কারণেই স্বামীবধে মহাবিষের আশ্রয়গ্রহণ! এক বিষের কথাতেই এত কথা মনে হইল। প্রভুর অন্তঃপুরে আমি জাএদার চক্ষের বিষ। আমাকে জ্বলন্ত অঙ্গার হইয়াই বাস করিতে হইল। স্বামীর হাব-ভাব, বিচার-ব্যবস্থায় তিন স্ত্রীর মধ্যে প্রকাশ্যে ইতর-বিশেষ কিছুই ছিল না। জাএদার চক্ষে আমি যাহা—হাস্‌নেবানুর চক্ষে কিন্তু আমি তাহার বিপরীত। হাস্‌নেবানু স্বামীগতপ্রাণ, স্বামীকে অকপটে হৃদয়ের সহিত ভালবাসেন! সেই ভালবাসা—স্বামীর গুপ্ত ভালবাসা আমাকে ভাবিয়া—ভালবাসায় ভালবাসা-জ্ঞানে আমাকেও তিনি হৃদয়ের সহিত ভালবাসিলেন। তিনি আমাকে বিশ্বাস করিলেন—আমার প্রতি তাঁহার ভালবাসার কারণ কি? আমার মনে হইল যে, সপত্নী জাএদা তাঁহার অন্তরে যে প্রকার দুঃখ দিয়াছিল, আমার দ্বারা তাহা পরিমাণ অনুযায়ী পরিশোধ হইল ভাবিয়াই,