পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৬৪

পদস্পৃষ্ট হইলেই আমরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জ্জন করিব। এলাহি! হাসানের প্রাণ আমাদের প্রার্থনীয়। সে প্রাণ রক্ষা হইলে সমস্তই রক্ষা হইবে। এলাহি! হাসানের প্রাণ রক্ষা কর; মদিনার পবিত্রতা রক্ষা কর; নূরনবী হজরত মোহাম্মদের রওজার পবিত্রতা রক্ষা কর!”

 এই প্রকারে উপাসনা শেষ করিয়া নগরবাসিনী কামিনীগণ হাসানকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন,—“এলাহির অনুগ্রহ-কবচ আপনার শরীর রক্ষা করুক। বাহুবলে হজরত আলীর দৃষ্টিপাত হউক। বিবি ফাতেমা খাতুনে জেন্নাত আপনার ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের প্রতি দৃষ্টি রাখুন। শক্রবিজয়ী হইয়া আপনি নির্ব্বিঘ্নে নগরে আগমন করুন।

 এইরূপ আশীর্ব্বাদ করিয়া কামিনীগণ স্ব স্ব নিকেতনে চলিয়া গেলেন। হাসানও বিস্‌মিল্লাহ্ বলিয়া অশ্বে আরোহণ করিলেন। মুহূর্ত্ত-মধ্যে নগরপ্রান্তে অসিয়া ভীষণতর শব্দ শুনিতে পাইয়া তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটস্থ হইলেন। দেখিলেন যে, বিষম বিক্রমে মদিনাবাসীরা বিপক্ষগণকে আক্রমণ করিয়াছে। যুদ্ধের রীতিনীতির প্রতি কাহারও লক্ষ্য নই। কেরল ‘মার মার’ অস্ত্রের ঝন্‌ঝন্‌ ও মুহূর্ত্তে মুহর্ত্তে “আল্লাহ” রবে চতুর্দ্দিক কাঁপাইয়া তুলিতেছে, রণভূমিতে শোণিতের প্রবাহ ছুটিয়াছে। সেই অভাবনীয় ভয়ানক দৃশ্য দেখিয় হাসান নিস্তব্ধভাবে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট রহিলেন, যুদ্ধে ব্যাপৃত হইলেন না।

 মদিনাবাসীরা শত্রুদিগকে প্রায় শেষ করিয়া ফেলিয়াছে। বিধর্ম্মীর মস্তকচ্ছেদন করিয়া শেষে নিজে নিজে “শহীদ” হইতেছে। কেহ কাহারও কথা শুনিতেছে না, কাহাকেও কিছু বলিতেছে না, বা জিজ্ঞাসাও করিতেছে না। হোসেনের চালিত তরবারি বিদ্যুতের ন্যায় চমকিতেছে। শত্রুপক্ষীয়েরা যে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করবে, তারও উপায় নাই। তবে বহু দূর হইতে যাহারা সেই ঘূর্ণিত তরবারির চাক্‌চিক্য দেখিয়াছিল, কেবল তাহারাই কেহ জঙ্গলে, কেহ পর্ব্বতগুহায় লুকাইয়া প্রাণরক্ষা করিল।

 হোসেনের অশ্ব শ্বেত বর্ণ; তাহার শরীর ও শ্বেত বসনে আবৃত। এক্ষণে বিধর্ম্মী বিপক্ষদের রক্তে তাহা একেবারে লোহিতবর্ণে পরিণত হইয়াছে; কিন্তু স্থানে স্থানে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুভ্রাংশে আরও অধিক শোভা হইয়াছে।