পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৬৬

ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতার উপাসনা (শোক্‌রাণা) করিয়া বিজয়ী বীরপুরুষগণকে মহানন্দে অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। জাতীয় ধর্ম্ম ও জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া বীরগণ বিজয়পতাকা উড়াইয়া গৃহে আসিতেছেন, সে সময়ে “বাগে এরামে”র (স্বর্গীয় উপবনের) পুষ্প তাঁহাদের মস্তকে বর্ষণ করিতে পারিলেও নগরবাসীর আশা মিটিত না। নগরবাসীরা কি করেন, মদিনাজাত যাহা তাঁহাদের পারিজাত পুষ্প, মনের আনন্দে মহা উৎসাহে সেই পুষ্পগুচ্ছবৃষ্টি করিয়া বিজয়ীদের অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। বিজয়ী বীরগণ একেবারে প্রভু মোহাম্মদের রওজা শরীফে আসিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন। শেষে হাসান-হোসেন ও আবদর রহমানের নিকট বিদায় লইয়া সকলেই স্ব স্ব গৃহে গমনপূর্ব্বক পরিবার-মধ্যে সাদরে গৃহীত হইলেন। মদিনার প্রতি গৃহ, প্রতি দ্বার, প্রতি পল্লী ও প্রতি পথ এককালে আনন্দময় হইয়া উঠিল।

 মদিনাবাসীরা বিজয়-নিশান উড়াইয়া রণভূমি পরিত্যাগ করিলে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ-মধ্যে প্রাণের ভয়ে যাঁহারা লুকাইয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে তাঁহারা মস্তক উত্তোলন করিয়া দেখিলেন,—আর জনপ্রাণীমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে নাই। সহস্র সহস্র মস্তক, সহস্র সহস্র দেহ রক্তমাখা হইয়া বিকৃতভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। কেহ অশ্বসহ দ্বিখণ্ড হইয়া অশ্বদেহে চাপা পড়িয়াছে; কাহারও খণ্ডিত হস্ত পড়িয়া রহিয়াছে, শরীরের চিহ্নমাত্র নাই। কোন কোন শরীরে হস্ত নাই, কাহারও জঙ্ঘা কাটিয়া কোথায় পড়িয়াছে, অপরাংশ কোন অশ্বের পশ্চাৎ পদের সহিত রক্তে জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে। অশ্বদেহে মনুষ্যমস্তক, মনুষ্যদেহে অশ্বমস্তক সংযোজিত হইয়াছে। এইরূপ শোচনীয় অবস্থা অবলোকন করিয়া হতাবশিষ্ট সেনাগণ কি করিবেন, তাহা নির্দ্ধারণ করিতে পারিলেন না। ক্রমে ক্রমে দুইটি তিনটি করিয়া সকলে একত্র হইলেন। পর্ব্বতগুহায় যাঁহারা লুকাইয়াছিলেন, তাঁহারা যুদ্ধক্ষেত্রের নীরব নিস্তব্ধ ভাব বুঝিয়া ক্রমে ক্রমে বাহির হইলেন। তন্মধ্যে মারওয়ান ও ওৎবে অলীদ উভয়েই ছিলেন। সঙ্গীদিগের এই হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা আদৌ দুঃখিত হইলেন না। কেবল মারওয়ান বলিলেন, “ভাই অলীদ! মদিনাবাসীর অস্ত্রে এত তেজ, হোসেনের এত পরাক্রম, ইহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। যাহা হইবার হইয়াছে, গত বিষয়ের