পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যে খেলা জগৎ-বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর রোড্য, যিনি নিতান্ত জড় প্রস্তরের দেহ থেকে অসংখ্য জীবিতপ্ৰায় দেবদানব কেটে বার করেছেন, তিনিও শুনতে পাই, যখন-তখন হাতে কাদা নিয়ে আঙুলের টিপে মাটির পুতুল তায়ের করে থাকেন। এই পুতুল-গড়া হচ্ছে র্তার খেলা। শুধু রোড্যা কেন, পৃথিবীর শিল্পীমাত্রেই এই শিল্পের খেলা খেলে থাকেন। যিনি গড়তে জানেন তিনি শিবও গড়তে পারেন, বঁােদরও গড়তে পারেন। আমাদের সঙ্গে বড়ো বড়ো শিল্পীদের তফাত এইটুকু যে, তাদের হাতে এক করতে আর হয় না । সম্ভবত এই কারণে কলারাজ্যের মহাপুরুষদের যা-খুশি-তাই করবার যে অধিকার আছে, ইত্যর শিল্পীদের সে অধিকার নেই। স্বৰ্গ হতে দেবতার মধ্যে মধ্যে ভূতলে অবতীর্ণ হওয়াতে কেউ আপত্তি করেন না, কিন্তু মর্তবাসীদের পক্ষে রসাতলে গমন করাটা বিশেষ নিন্দনীয়। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, যখন এ জগতে দশটা দিক আছে, তখন এই সব-দিকেই গতায়াত করবার প্রবৃত্তিটি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। মন উঁচুতেও উঠতে চায়, নিচুতেও নামতে চায় ; বরং সত্য কথা বলতে গেলে, সাধারণ লোকের মন স্বভাবতই যেখানে আছে তারই চার পাশে ঘুরে বেড়াতে চায়— উড়তেও চায় না, ডুবিতেও চায় না। কিন্তু সাধারণ লোকে সাধারণ লোককে, কি ধর্ম, কি নীতি, কি কাব্য- সকল রাজোই অহরহ ডানায় ভর দিয়ে থাকতেই পরামর্শ দেয়। একটু উচুতে না চড়লে আমরা দর্শক এবং শ্রোতৃমণ্ডলীর নয়ন-মন আকর্ষণ করতে পারি নে। বেদিতে না বসলে আমাদের উপদেশ কেউ মানে না, রঙ্গমঞ্চে না চড়লে আমাদের অভিনয় কেউ দেখে না, আর কাঠমঞ্চে না দাড়ালে আমাদের বক্তৃতা কেউ শোনে না। সুতরাং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে থাকবার লোভে আমরাও অগত্যা চব্বিশ ঘণ্টা টাঙে চড়ে থাকতে চাই, কিন্তু পারি নে। অনেকের পক্ষে নিজের আয়ত্তের বহিভূত উচ্চস্থানে ওঠবার চেষ্টাটাই মহাপতনের কারণ হয়। এ-সব কথা বলবার অর্থ এই যে, কষ্টকর হলেও আমাদের পক্ষে অবশ্য মহাজনদের পথ অনুসরণ করাই কর্তব্য ; কিন্তু ডাইনে বঁায়ে ছোটােখাটাে গলিঘু জিতে খেলাচ্ছলে প্ৰবেশ করবার যে অধিকার তাদের আছে, সে অধিকারে আমরা কেন বঞ্চিত হব । গান করতে গেলেই যে সুর তারায় চড়িয়ে রাখতে হবে, কবিতা লিখতে হলেই যে মনের শুধু গভীর ও প্রখর ভাব প্ৰকাশ করতে হবে, এমন-কোনো নিয়ম থাকা উচিত নয়। শিল্পীরাজ্যে খেলা করবার প্রবৃত্তির ন্যায় অধিকারও বড়ো-ছোটো সকলেরই সমান আছে। এমন-কি, এ কথা বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, এ পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানে ব্ৰাহ্মণ-শূদ্রের