পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

PQ R Sg প্ৰতিমূর্তির ভিতর কিছু না-কিছু বিশেষত্ব আছে- পৃথিবীতে এমন দুটি পাতা নেই, যা এক-ছাঁচে ঢালা। ব্যক্তিত্বেই প্ৰাণীজগতের পরিচয়। তার পর, প্ৰাণ যত পরিপুষ্ট হয়, তত তার ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই ব্যক্তিত্ব নষ্ট করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে প্ৰাণকে নষ্ট করা। প্ৰাণ এতই অবাধ্য ও বেয়াড় যে, মানুষকে ও-বস্তু নিয়ে দিবারাত্র জ্বালাতন হতে হয়। আসলে ও-বস্তু হচ্ছে জড়াজগতের বুকের জ্বালাযেমন আলো তার গায়ের জালা। এরূপ হবারও কারণ আছে। জগদবিখ্যাত বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিন আবিষ্কার করেছেন যে, আদিতে পৃথিবীতে প্ৰাণ ছিল না, কোনো অজানা অতীতের কোনো-এক অশুভ মূহুর্তে কোনো অজানা অতিপৃথিবী থেকে প্ৰাণ শূন্যপথে উদ্ধাযোগে মর্তভূমিতে অবতীর্ণ হয়। প্ৰাণের সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এই জড়পৃথিবীর অন্তরে যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সে আগুন দেশেবিদেশে ছড়িয়ে, পড়েছে এবং নানা বস্তুর ভিতর দিয়ে নানা আকারে নানা বর্ণে নানা ভঙ্গিতে জলে উঠেছে। জড়জগৎ এ আগুন নেবাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ কৃতকাৰ্য হতে পারছে না । আমাদের মনোজগতে প্ৰাণ যে কোথা থেকে এল, সে সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। অনেকের ধারণা, এ দেশে ও-বস্তু বিলেতে থেকে এসেছে। কিন্তু ইতিপূর্বেও এ দেশে যে প্ৰাণ ছিল, তার প্রমাণ আছে। আমার বিশ্বাস, কোনো অতিমনোজগৎ থেকে কোনো মানসী-উল্কার স্কন্ধে ভর করে। প্ৰাণ মানুষের মনের মধ্যে প্ৰবেশ করেছে। র্যার মনের ভিতর কখনো নূতন প্ৰাণের আবির্ভাব হয়েছে, তিনিই জানেন যে, সে প্ৰাণ উস্কার মতো আসে ; অর্থাৎ হঠাৎ এসে পড়ে, আর তার দীপ্ত আলোকে সমস্ত মনটাকে উদ্দীপ্ত উত্তপ্ত করে তোলে। গ্যেটে বলেছেন যে, মানুষের মনে নুতন ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গেই নূতন জীবন জন্মলাভ করে। আর ভালোবাসা যে উল্কার মতো আমাদের মনের উপর এসে পড়ে, এ সত্য সকলেই জানেন । সুতরাং একটা আকস্মিক উপদ্রবের মতো প্ৰাণের আবির্ভাব হয়। এ বিষয়ে হৃদয় ও মস্তিষ্ক সমধর্মী । এ জগতে আমরা যাকে সত্য বলি, তাও কোনো অজানা দেশ থেকে অকস্মাৎ এসে সমগ্র অন্তর্লোককে আলোকিত করে আবিভূত হয়। খড়ি পেতে গণনা করে অন্যাবধি কোনো দার্শনিক কিংবা বৈজ্ঞানিক কোনো সত্যই আবিষ্কার করতে পারেন নি । এবং যে সত্যের ভিতর প্রাণের আগুন আছে, তা মিথ্যাকে জালিয়ে-পুড়িয়ে খায় । সুতরাং একের আবিষ্কৃত সত্যের জালা বহুলোককে সহ্য করতে হয়। এবং মানবমনুর যে অংশ জড়, সে অংশ মনের এই প্ৰক্ষিপ্ত ক্ষিপ্ত ও দীপ্ত আগুনকে নেবাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ কৃতকাৰ্য হতে পারে নি।