পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যে চাবুক 8 Y 'অপরের উপর অত্যাচার করবার জন্য শারীরিক বলের প্রয়োগটা যে বর্বরতা, এ কথা সকলেই মানেন ; কিন্তু একই উদ্দেশ্যে নৈতিক বলের প্রয়োগটাও যে বর্বরতামাত্র, এ সত্য আজও সকলের মনে বসে যায় নি। কঠিন শাস্তি দেবার প্রবৃত্তিটি আসলে রূপান্তরে প্ৰতিহিংসাপ্রবৃত্তি। ও জিনিসটিকে সমাজের মঙ্গলজনক মনে করা শুধু নিজের মনভোলানো মাত্র। নীতিরও একটা বোকামি গোড়ামি এবং গুণ্ডামি আছে। নিত্যই দেখতে পাওয়া যায়, একরকম প্ৰকৃতির লোকের হাতে নীতি পদার্থটা পরের উপর অত্যাচার করবার একটা অন্ত্রমাত্র। ধর্ম এবং নীতির নামে মানুষকে মানুষ যত কষ্ট দিয়েছে, যত গৰ্হিত কাৰ্য করেছে, এমন বোধ হয় আর কিছুরই সাহায্যে করে নি। আশা করি দ্বিজেন্দ্ৰবাবু সে শ্রেণীর লোক নন, যাদের মতে সুনীতির নামে সাত খুন মাপ হয়। ইতিহাসে এর ধারাবাহিক প্ৰমাণ আছে যে, নীতির বোকামি গোঁড়ামি এবং গুণ্ডামির অত্যাচার সাহিত্যকে পুরোমাত্রায় সহ্য করতে হয়েছে। কারণ সাহিত্য সকল দেশে সকল যুগেই বোকামি গোড়ামি এবং গুণ্ডামির বিপক্ষ এবং প্ৰবল শক্ৰ । নীতির, অর্থাৎ যুগবিশেষে প্ৰচলিত রীতির, ধর্মই হচ্ছে মানুষকে বাধা; কিন্তু সাহিত্যের ধর্ম হচ্ছে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। কাজেই পরস্পরের সঙ্গে দা-কুমড়োর সম্পর্ক। ধর্ম এবং নীতির দোহাই দিয়েই মুসলমানের আলেকজাণ্ডিয়ার লাইব্রেরি ভস্মসাৎ করেছিল। এ যুগে অবশ্য নীতিবীরদের বাহুবলের এক্তিয়ার হতে আমরা বেরিয়ে গেছি, কিন্তু সুনীতির গোয়েন্দারা আজও সাহিত্যকে চোখে-চোখে রাখেন, এবং কারো লেখায় কোনো ছিদ্র পেলেই সমাজের কাছে লেখককে ধরিয়ে দিতে উৎসুক হন । কাব্যামৃত রসাস্বাদ করা এক, কাব্যের ছিদ্রান্বেষণ করা আর । শ্ৰীকৃষ্ণের বঁাশি কবিতার রূপকমাত্র। কারণ, সে বঁাশির ধর্মই এই যে, তা ‘মনের আকুতি বেকত করিতে কত নাসন্ধান জানে”। ছিদ্রান্বেষী নীতিধর্মীদের হাত পড়লে সে বঁাশির ফুটাগুলো যে তঁরা বুজিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন, তাতে আর সন্দেহ কী ৷ একশ্রেণীর লোক চিরকালই এই চেষ্টা করে অকৃতকাৰ্য হয়েছেন; কারণ, সে ছিদ্র স্বয়ং ভগবানের হাতে-করা বিধ, তাকে নিরেট করে দেবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। ‘মি’ জিনিসটিই খারাপ, কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰমতে, মানুষের পক্ষে সবচাইতে সর্বনেশে 'মি' হচ্ছে “আমি” । কারণ, ও পদার্থটির আধিক্য থাকলে আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি কাণ্ডজ্ঞান সবই লুপ্ত হয়ে আসে। অন্যান্য সকল 'মি' ঐ “আমি”কে আশ্ৰয় করেই থাকে। কিন্তু “আমি” এত অব্যক্তভাবে আমাদের সমস্ত মনটাঙ্গ ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে যে, আমরা নিজেও বুঝতে পারি নে যে, তারই তাড়নায় আমরা পরের উপর কুব্যবহার করতে উদ্যত হই, সমাজ কিংবা সাহিত্য কারো মঙ্গলের জন্য নয়। এই কথাটা স্পষ্ট বুঝতে পারলে আমরা পরের উপর নৈতিক চাবুক প্রয়োগ করতে কুষ্ঠিত