পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8V বীৱবলের হালখাতা সভ্যতা নিজস্ব হয়ে উঠবে, এবং ঐ ক্রিয়ার সাহায্যেই আমরা নিজেদের প্রাণের পরিচয় পাব, এবং বাঙালির বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তুলব। তরজমার আবশ্যকত্ব স্থাপনা করে এখন কী উপায়ে আমরা সে বিষয় কৃতকাৰ্য হব সে সম্বন্ধে আমার দু-চারটি কথা বলবার আছে। সাধারণত লোকের বিশ্বাস যে, কথার চাইতে কাজ শ্রেষ্ঠ। এ বিশ্বাস বৈষয়িক হিসাবে সত্য এবং আধ্যাত্মিক হিসাবে মিথ্যা। মানুষমাত্রেই নৈসৰ্গিক প্ৰবৃত্তির বলে সংসারযাত্রার উপযোগী সকল কাৰ্য করতে পারে ; কিন্তু তার অতিরিক্ত কর্ম— যার ফল একে নয়, দশে লাভ করে, তা- করবার জন্য মনোেবল আবশ্যক। সমাজে সাহিত্যে যা-কিছু মহৎকৰ্য অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মূলে মন-পদার্থটি বিদ্যমান। যা মনে ধরা পড়ে তাই প্ৰথমে কথায় প্ৰকাশ পায়, সেই কথা অবশেষে কাৰ্যরূপে পরিণত হয় ; কথার সূক্ষ্মশরীর কার্যরূপ স্থূলদেহ ধারণ করে। আগে দেহটি গড়ে নিয়ে, পরে তার প্রাণপ্ৰতিষ্ঠা করবার চেষ্টাটি একেবারেই বৃথা। কিন্তু আমরা রাজনীতি সমাজ-নীতি ধর্ম সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণের সন্ধান না করে শুধু তার দেহটি আয়ত্ত করবার চেষ্টা করায় নিত্যই ইতো নষ্টস্ততে ভ্ৰষ্ট হচ্ছি। প্ৰাণ নিজের দেহ নিজের রূপ নিজেই গড়ে নেয়। নিজের অন্তর্নিহিত প্ৰাণশক্তির বলেই বীজ ক্রমে বৃক্ষ-রূপ ধারণ করে। সুতরাং আমরা যদি ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণে প্ৰাণবন্ত হয়ে উঠতে পারি, তা হলেই আমাদের সমাজ নবকলেবর ধারণ করবে। এই নবসভ্যতাকে মনে সম্পূর্ণরূপ পরিপাক করতে পারলেই আমাদের কান্তি পুষ্ট হবে। কিন্তু যতদিন সে সভ্যতা আমাদের মুখস্থ থাকবে কিন্তু উদারস্থ হবে না, ততদিন তার কোনো অংশই আমরা জীৰ্ণ করতে পারব না। আমরা যে ইউরোপীয় সভ্যতা কথাতেও তরজমা করতে পারি নি, তার প্রত্যক্ষ প্ৰমাণ এই যে, আমাদের নূতন শিক্ষালব্ধ মনোভাবসকল শিক্ষিত লোকদেরই রসনা আশ্রয় করে রয়েছে, সমগ্ৰ জাতির মনে স্থান পায় নি। আমরা ইংরেজি ভাব ভাষায় তরজমা করতে পারি নে বলেই, আমাদের কথা দেশের লোকে বোঝে না, বোঝে শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত লোক। এদেশের জনসাধারণের নেবার ক্ষমতা কিছু কম নয়, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে তারা যে কিছু পায় না, তার একমাত্র কারণ আমাদের অন্যকে দেবার মতো কিছু নেই; আমাদের নিজস্ব বলে কোনো পদার্থ নেই- আমরা পরের সোনা কানে দিয়ে অহংকারে মাটিতে পা দিই নে। অপরপক্ষে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেবার মতো ধন ছিল তাই তাদের মনোভাব নিয়ে আজও সমগ্র জাতি ধনী হয়ে আছে। ঋষিবাক্যসকল লোকমুখে এমনি সুন্দর ভাবে তরজমা হয়ে গেছে যে, তা আর তরজমা বলে কেউ বুঝতে পারেন না। এ দেশের অশিক্ষিত লোকের রচিত বাউলের গান কাউকে আর উপনিষদের ভাষায় অনুবাদ করে