পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G9V9 বীরবলের হালখাতা জল। বর্ষার হাওয়া এতই দুরন্ত এতই অশিষ্ট এতই প্ৰচণ্ড এবং এতই স্বাধীন যে, সেযে কোনো অসভ্য দেশ থেকে আসে, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার পর, বর্ষার নিজস্ব আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ । বিদ্যুতের আলো এতই হস্যোজ্জল এতই চঞ্চল এতই বক্র এবং এতই তীক্ষা যে, এই প্ৰশান্ত মহাদেশের এই প্ৰশান্ত মহাকাশে সে কখনোই জন্মলাভ করে নি। আর-এক কথা, বসন্ত হচ্ছে কলকণ্ঠ কোকিলের পঞ্চম সুরে মুখরিত। আর বর্ষার নিনাদ ? তা শুনে শুধু যে কানে হাত দিতে হয় তা নয়, চোেখও বুজতে হয়। বর্ষার প্রকৃতি যে আমাদের প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত, তার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় ও-ঋতুর ব্যবহারে। এ-ঋতু শুধু বেখাপ্পা নয়, অতি বেআড়া। বসন্ত যখন আসে, সে এত অলক্ষিতভাবে আসে যে, পঞ্জিকার সাহায্য ব্যতীত কবে মাঘের শেষ হয়। আর কবে ফাস্তুনের আরম্ভ হয়, তা কেউ বলতে পারেন না । বসন্ত, বঙ্কিমের রজনীর মতো ধীরে ধীরে অতিধীরে ফুলের ডালা হাতে করে দেশের হৃদয়-মন্দিরে এসে প্ৰবেশ করে। তার চরণস্পর্শে ধরণীর মুখে, শব-সাধকের শবের ন্যায়, প্ৰথমে বর্ণ দেখা দেয়, তার পরে ভ্ৰ কম্পিত হয়, তার পরে চক্ষু উন্মীলিত হয়, তার পর তার নিশ্বাস পড়ে, তার পর তার সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়ে ওঠে। এ-সকল জীবনের লক্ষণ শুধু পৰ্যায়ক্রমে নয়, ধীরে ধীরে অতিধীরে প্রকটিত হয়। কিন্তু বর্ষা ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করে একেবারে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে। আকাশে তার চুল ওড়ে, চোখে তার বিদ্যুৎ খেলে, মুখে তার প্রচণ্ড হুংকার ; সে যেন একেবারো প্ৰমত্ত, উন্মত্ত । ইংরেজেরা বলেন, কে কার সঙ্গ রাখে, তার থেকে তার চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। বসন্তের সখা মদন। আর বর্ষার সখা ?-- পবননন্দন নন, কিন্তু তার বাবা । ইনি একলম্বেফ আমাদের অশোকবনে উত্তীর্ণ হয়ে ফুল ছেড়েন, ডাল ভাঙেন, গাছ ওপড়ান ; আমাদের সোনার লঙ্কা একদিনেই লণ্ডভণ্ড করে দেন, এবং যে সুৰ্য আমাদের ঘরে বাধা রয়েছে তাকে বগলদাবা করেন ; আর চন্দ্রের দেহ ভয়ে সংকুচিত হয়ে তার কলঙ্কের ভিতর প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এককথায়, বর্ষার ধর্ম হচ্ছে জল-স্থল-আকাশ সব বিপৰ্যন্ত করে ফেলা। এ-ঋতু কেবল পৃথিবী নয়, দিবাৱাত্রেরও সাজানো তাস ভেস্তে দেয় । তা ছাড়া বর্ষা কখনো হাসেন কখনো কঁদেন, ইনি ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট । এমন অব্যবস্থিতচিন্তু ঋতুকে ছন্দোবন্ধের ভিতর সুব্যবস্থিত করা আমার সাধ্যাতীত । এ স্থলে এই আপত্তি উঠতে পারে যে, বর্ষার চরিত্র যদি এতই উদ্ভট হয়, তা হলে কালিদাস প্রভৃতি মহাকবিরা কেন ও-ঋতুকে তঁদের কাব্যে অতখানি স্থান দিয়েছেন। তার উত্তর হচ্ছে যে, সেকালের বর্ষা আর একালের বর্ষা এক জিনিস নয় ; নাম ছাড়া