পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৌরাঙ্গ ও তাহার পরিকরবর্গ ANSAS) এবার তাহা জুড়াইয়া গেল। বৃদ্ধ পণ্ডিত চৈতন্তের দেবমূৰ্ত্তি আবিষ্কার করিয়া শ্লোকচ্ছন্দে র্তাহার স্তব পাঠ করিতে লাগিলেন। এই ভাবে কাশীর প্রকাশানন্দ চৈতন্তের কতই নিন্দা করিয়াছিলেন, কিন্তু যখন চৈতন্যের অপূর্ব ভক্তিব্যাখ্যা শুনিয়া সেই সৰ্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও দণ্ডীদের নেতা সন্ন্যাসী বাঙ্গালী বালককে গুরু বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন, তখন কাশীতে হুলস্থল পড়িয়া গিয়াছিল। দাক্ষিণাত্যের সুপ্ৰসিদ্ধ চুওঁীরাম তীর্থ, ভারতী গোঁসাই প্রভৃতি বড় বড় পণ্ডিতের দশাও একই রূপ হইল। কিরূপে তিনি গুজরাটে ঘোগাগ্রামে নটী-শ্রেষ্ঠ সুন্দরী বারমুখীকে সৎপথে আনিয়াছিলেন, তাহা ভক্তমালে৷ আভাসে বর্ণিত আছে, কিন্তু গোবিন্দ কৰ্ম্মকার তাহার এমন বিস্তারিত বর্ণনা দিয়াছেন, যে তাহা একটি দৃশ্যপটের ন্যায় মনোহর হইয়াছে। খাণ্ডবা গ্রামে সেবাদাসী ইন্দিরা বাই, নারোজী দাসু্য, ভিল পান্থ প্ৰভৃতি দুশ্চরিত্র ব্যক্তিগণের কি অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, তাহার শ্ৰীকণ্ঠে হরিনাম শোনার পর । তাহার মুখে চোখে যে অপূর্ব অধ্যাত্ম শক্তি ফুটিয়াছিল,-গলদশ্র শতদলপ্ৰভা চোখে যে স্বৰ্গীয় প্রেমের কথা লিখিত ছিল, তাহাতেই ঐ সকল অসাধ্যসাধন সম্ভবপর হইয়াছিল। তিনি উপদেশ অতি অল্পই দিয়াছেন। জগতের ইতিহাসে এরূপ আর দ্বিতীয় ব্যক্তি দেখা যায় ন-যিনি উপদেশ, ব্যাখ্যা, বক্তৃতা প্ৰভৃতি চির-ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহাব না করিয়া শুধু নাম-বলে লোকের চিত্ত এমন ভাবে আকর্ষণ করিয়াছেন। যে মহাধনী তীর্থরাম যুবক দুইটি বেখ্যা লইয়া তাহাকে বিচলিত করিতে আসিয়াছিল—সে তাহার মুখে শুধু হরিনাম শুনিয়া স্বয়ং দণ্ড-কমণ্ডলু হাতে লইয়া সন্ন্যাসী সাজিল, তাহার নিযুক্ত সত্যবাই ও লক্ষ্মীবাইনামক বেশ্যাম্বয় রূপের গর্বে ফাটিয়া পড়িয়াছিল- তাহারা এই প্ৰেমোন্মাদের ভাগবস্তুক্তির উচ্ছাস দেখিয়া কঁাদিয়া পায়ে পড়িল। ষাট বৎসরের ব্রাহ্মণ দৃস্থ্য নারোজি-চৈতন্যের প্রেমোচ্ছাস দেখিয়া পাগল হুইয়া গেল, সে তাহার অস্ত্রশস্ত্র সমস্ত চিরতরে ফেলিয়া দিয়া সেই দিন হইতে চৈতন্যের যে সঙ্গ লইল, মৃত্যুর দিন পৰ্যন্ত তাহা ছাড়ে নাই। ত্ৰিবন্ধুরের রাজা রুদ্রপতি, উডিন্যার প্রবলপ্রতাপান্বিত রাজা প্ৰতাপরুদ্র চৈতন্যের পিছনে পিছনে অনুগত সেবকের ন্যায় চলিতেন। যে প্রতাপরুদ্রের কবাট-তুল্য বিশাল বক্ষের মর্দনে প্রধান প্ৰধান পাঠান মল্পগণ নিম্পেষিত হইতেন, কবিকর্ণপুর সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসু হইয়াছিলেন---এই মহাবীর রাজরাজেশ্বর চৈতন্যকে দেখিলে নবনীতের ন্যায় কোমল হইয় তাহার দাসানুদাস হইতেন কোন গুণে ? এই প্ৰতাপরুদ্র হুসেন সাহের হাত হইতে গৌডদেশ কাড়িয়া লইবার জন্য একবার সমরোদেযাগ করিয়াছিলেন । ইনি দাক্ষিণাত্যের অনেক প্রদেশ জয় করিয়া সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী হইয়াছিলেন । ইহার আদেশে চৈতন্যের যে ছবি আঁকা হইয়াছিল, তাহার পাদপীঠে—সৰ্বাঙ্গপ্ৰণতির ভঙ্গীতে রাজার ভুলুষ্ঠিত মূৰ্ত্তি অঙ্কিত রছিয়াছে। ইনিই চৈতন্তেব সঙ্কীৰ্ত্তন শুনিয়া গোপীনাথ মিশ্রকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “এ কোন রাগিণী ? অর্থবােধ না হইলেও যেমন কোকিল-কাকলী, এ যে তেমনই মিষ্টি, এরূপ মধুর রাগিণী ত আমি শুনি নাই, ইহা কে উদ্ভাবন করিয়াছেন ?” গোপীনাথ মিশ্র বলিলেন“ইহা মনোহর-সাই কীৰ্ত্তন, ইহার স্রষ্টা স্বয়ং চৈতন্যদেব।” প্রতাপরুদ্র রাজা পুরুষোত্তম দেবের