পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৌরাঙ্গ ও তঁাহার পরিকরবর্গ o চৈতন্যের অনুজ্ঞাক্ৰমে বৈষ্ণব-সমাজে সমস্ত নীচজাতির প্রবেশ-দ্বার উন্মুক্ত করিয়া নিত্যানন্দ তাহাদিগকে অশেষরূপ সামাজিক দুৰ্গতি হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন । এজন্য তঁহাদের শ্ৰদ্ধায় নিত্যানন্দের নাম চৈতন্যকেও ছাপাইয়া উঠিয়াছে। কতকগুলি গানে এই কথা সুব্যক্তি আছে । “হাটের রাজা নিত্যানন্দ, পাত্ৰ হৈল শ্ৰীচৈতন্য” প্ৰভৃতি গানে নিত্যানন্দ রাজা এবং চৈতন্য র্তাহার প্রধান মন্ত্রী বলিয়া পরিকল্পিত হইয়াছেন । নিত্যানন্দ এই মহৎ কাৰ্য্য না করিলে আজ পতিত জাতির অধিকাংশই ইসলাম ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিত। চৈতন্যদেব পুরীতে র্তাহাকে সমাজ-সংস্কারসম্বন্ধে কোন পন্থা অবলম্বনীয়,—দ্বােব বন্ধ করিয়া এক প্ৰকোষ্ঠে অতি গোপনীয়ভাবে সেই উপদেশ দিতেন । চৈতন্য স্বয়ং ভগবৎপ্রেমে বিভোর থাকিয়াও বাঙ্গলার নবগঠিত বৈষ্ণব-সমাজকে সংশোধিত ও নিয়ন্ত্রিত করিবার সমস্ত উপায অবলম্বন করিয়াছিলেন। সনাতনকে দিয়া তিনি এই সমাজের জন্য বিধিব্যবস্থা সংকলন করাইয়াছিলেন । এই কাৰ্য্যের জন্য সনাতন অপেক্ষা যোগ্যতার ব্যক্তি কেহ ছিলেন না। সনাতন বাঙ্গলার সমাটের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন, ব্যবহার-শাস্ত্ৰ তাহার নখাগ্রে ছিল, তিনি হিন্দুদের দর্শন, কাব্য ও পুবাণ উৎকৃষ্টৰূপে পড়িয়াছিলেন, কিন্তু স্থতিই ছিল তাহার বিশেষভাবে পঠিতব্য বিষয় । আশাচৰ্য্যের বিষয়, নবদ্বীপের তরুণ পাগল দেবতাটি ভাবে বিভোব থাকিয়া ও সংসারেব প্ৰযোজন এবং স্মৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্বসম্বন্ধে সনাতনের সাত পণ্ডিতকে কলেব পুতুলেব ন্যাধি পরিচালিত করিয়াছিলেন। এসম্বন্ধে চৈতন্য-চরিতামৃতের সনাতন-শিক্ষা শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য । একদিকে সমাজ-সংস্কাৰ, অপবদিকে উহা পবিচালিত করিবার বিধি-ব্যবস্থা করিয়া তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজেব প্ৰাণ-প্ৰতিষ্ঠা করিয়াছিলেন । কে জানিত হরিপ্রেমে উন্মাদ এই তৰুণ যুবকেৰ একপূ অসাধারণ সমাজ-সংগঠনী শক্তি ও প্রতিভা ছিল ? তাহার “মহা-ভাব” অতুলনীয়-সমুদ্রের মত অপ্ৰমেয় । সেই মহাভাবের সৌন্দৰ্য্যে বৈষ্ণবপদ সাহিত্য ভবপুর ; চণ্ডীদাস তাহাব আভাস পাইয়া তাহার আগমনী গাহিয়াছিলেন, বাসুঘোষ নরহবি ভঁাহাব স্বৰ্গীয় প্রেমলীলায় আত্মহারা হইয়া শত শত পদ রচনা কবিয়াছেন । হরিনাম করিতে করিতে যখন তিনি কঁাদিতেন, তখন নারদের বীণাধবনিবৎ তাহার সুকণ্ঠ-উচ্চারিত হরিলীলা যেন শ্রোতৃবর্গের প্রত্যক্ষ হইত। এই মনোহর কণ্ঠের ধ্বনিতে নূতন নূতন সুরের মূৰ্দ্ধনা জাগিয উঠিত । শুধু মনোহর সাহী, রেনেট বা গরান-হাটার কীৰ্ত্তন নহে,-একদিন এমনই করুণ-মধুর কণ্ঠে তিনি সাশ্রনেত্ৰে হরিনাম কীৰ্ত্তন করিতেছিলেন যে তাহাতে “মায়ুর” নামক এক নবরাগিণীব স্বষ্টি হইয়া গেল। তাহার প্রেম-বিহবল চােখের মধুরিমা মুহুর্তে মুহূৰ্ত্তে নানাভাবে নানা মধুর বার্তা মর্ত্যলোকে বহন করিয়া আনিত। একদিন তাহার চোখে অভিমানের অরুণিমা খেলিতেছিল, অতিশয় অভিমান ও লজ্জাজনিত ক্ষোভ দুইটি অশ্রুতে সুব্যক্ত হইয়াছিল, তঁহার চোখে কি কথা ফুটিতে চাহিয়া যেন ফুটিতে পারিতেছিল ୩, দেহলতা অতিশয় আবেগে দুলিতেছিল। রূপ-গোস্বামী মুগ্ধনেত্রে এই মহাভাবের পাগলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, অমনি সেই দৃশ্য তঁাহাকে কল্পনার স্বৰ্গলোকে লইয়া গেল, বৃহৎ বঙ্গ/৫২