পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve বৃহৎ বঙ্গ পাওয়া যাইবে না, এই বিশ্বাসে ইনি নরোত্তমের ফাঁদে পা দিলেন। বহু তর্ক ও আলোচনার পর তিনি দেখিলেন, ইহারা দেবদূতের ন্যায় দেশে যে নুতন সংবাদ আনিয়াছেন তাহা গ্ৰহণ না করিলে বাঙ্গালীর উদ্ধারের দ্বিতীয় পন্থা নাই। পরাভূত এবং সম্যগন্ধপ নুতন ভাবে প্রণোদিত হইয়া স্পন্ধিত ও দুর্দান্ত গঙ্গানারায়ণ স্বয়ং নরোত্তমের শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করিলেন। কিন্তু নরোত্তমের প্রধান সংস্কারকাৰ্য্য গৌড়দ্ধারে হইয়াছিল। গৌড়দ্ধার রাজমহলের নিকটবৰ্ত্তী। তথাকার রাজা রাঘবেন্দ্র অতি প্রভাবশালী ব্ৰাহ্মণ ভূস্বামী ছিলেন, তাহার দুই পুত্ৰ চাদ রায় ও সন্তোষ রায় । ইহারা অতি প্ৰবল পরাক্রান্ত দসু্য হইয়া উঠিয়াছিলেন। পাঠান বাদশাহ মোগল সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্ৰহে লিপ্ত ছিলেন, সুতরাং এই রাজার রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, তখন বাদশাহ ইহদিগকে র্যাটাইতে ইচ্ছা করেন নাই। মোগলদের সঙ্গে লড়াই করিবার জন্য দাউদ খাঁ সৰ্ব্বস্ব পণ করিয়া বসিয়াছিলেন, তিনি সমস্ত নৃপতিদিগের বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া ব্যলক্ষয় করা সময়োচিত মনে করেন নাই। কয়েকবাব বাদশাহের কৰ্ম্মচারীরা রাজস্ব আদায় করিতে গৌড়দ্বারে গিয়াছিলেন, কিন্তু চাদ রায় তাহাদিগকে মারিয়া ধরিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিলেন। একটি নিরপরাধ ব্ৰাহ্মণকে হত্যা করার পর চাদ রায় বায়ুরোগগ্ৰস্ত হইলেন, তাহার ঘন ঘন মূৰ্ছা হইত, এবং তিনি প্ৰলাপ বকিতেন। এতবড় দুৰ্দান্ত রাজা একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া অকৰ্ম্মণ্য হইয়া পড়িলেন। চাঁদ রায় এই অবস্থায় স্বপ্ন দেখিলেন, কেহ যেন বলিতেছে“খেতুরীর সন্ন্যাসী রাজ-কুমারের শরণা লইলে তাহার রোগ আরোগ্য হইবে।” কিন্তু অহঙ্কারী ব্ৰাহ্মণ রাজা-একটা কায়স্থের শরণ লওয়ার কথা তঁহার পক্ষে অসহ্য । বৃথা কল্পনাজাত স্বপ্ন মনে করিয়া তিনি কথাটা উড়াইয়া দিলেন, কিন্তু রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল এবং লোকেরা বলাবলি করিতে লাগিল—সেই নিৰ্দোষ হত ব্ৰাহ্মণের ভূত চাঁদ রায়ের কঁাধে চাপিয়াছে। ভিষকদের আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হইল, চাদ রায়ের অবস্থা শঙ্কটাপন্ন হইল। এ অবস্থায় সমস্ত অহঙ্কার বিসর্জন দিয়া বৃদ্ধ রাজা রাঘবেন্দ্র রায় নরোত্তমকে আনিবার জন্য লোক পাঠাইলেন । নরোত্তম আসিলেন না, বলিয়া পাঠাইলেন, তিনি যাদুবিদ্যা জানেন না, তাহার কোন অলৌকিক ক্ষমতা নাই। তিনি চাদ রায়ের দুঃসাধ্য রোগ সারাইবেন কিরূপে ? কিন্তু এবার অনুতপ্ত চাদ রায় প্ৰাণের দায়ে অনেক কাকুতি মিনতি করিয়া স্বয়ং চিঠি লিখিলেন-রোগও যদি না সারে, তবে তাহার মুখে মৃত্যুকালে হরিনাম শুনিলেও একটা গতি হইবে। এবার নরোত্তম থাকিতে পারিলেন না, কারণ পাপী আৰ্ত্ত হইয়া ডাকিয়াছে। তিনি তাহার অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু বুধুরির সুবিখ্যাত পণ্ডিত ও ভিষক এবং কবিকুলচুড়ামণি গোবিন্দদাসের সহোদর রামচন্দ্ৰ কবিরাজকে সঙ্গে লইয়া গৌড় দ্বারে উপস্থিত হইলেন। তাহারা রাজধানীতে বিপুলভাবে সংবন্ধিত হইলেন। চাদ রায়ের ব্যাধি ছিল মানসিক । কতকটা নরোত্তমের প্রাণ-জুড়ানো উপদেশে। কতকটা বা রামচন্দ্ৰ কবিরাজের চিকিৎসার ফলে তাহার মনের উপর বৈষ্ণব-প্রভাব খুব হিতকর হইল। চাদ রায় অল্পদিনের মধ্যে সারিয়া উঠিলেন। তখন নরোত্তমের উপর তাহার অচলা চাদ রায়ের পীড়া ।