পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গুরুবাদ ও পরকীয়া ԳԵՏ চােখে পড়ে নাই, অতিথির স্পৰ্দ্ধার কথা, রাজার নিৰ্ব্ববুদ্ধিতার কথা, তাহারা ভাবে নাই। যদি ভাবিতে পারিত, তবে বঙ্গমহিলা সুস্থ —সবলদেহে মৃত স্বামীর পাশে শুইয়া হরিনাম করিতে করিতে পরমানন্দে পুড়িয়া ছাই হইতে পারিত না। কাঞ্চনমালা যে স্বামীর ভালবাসার জন্য সর্বস্ব পণ করিয়াছিল, সেই স্বামীকে সহজে এই কড়ারে সপত্নীকে দিয়া গেল যে, সে তাহাকে আর জীবনে দেখিতে পাহবে না। সন্ন্যাসী বলিয়াছিলেন, যদি তোমার একফোটা অশ্রু পড়ে তবে তোমার সাধনা ব্যর্থ হইবে। অন্ধ স্বামী চক্ষু ফিরিয়া পাইবেন, এই আনন্দে সে যে আজ দীন ভিখারিণী অপেক্ষাও হীন হইয়া সৰ্ব্বস্বহার হইল“অন্ধাবন্ধুর” জন্য স্বামীকে ছাড়িয়া রাজকন্যা ভিখারিণী হইল। স্বামীর কাছে সে নিজেকে ভিক্ষাস্বরূপ চাহিয়া লইল। এই সমস্তই আতিশয্য-কল্পনা এই সকল স্থানে পৃথিবী ডিঙ্গাইয়া চলিয়া গিয়াছে-বাঙ্গালী সীতা-সাবিত্রীর সাধনা তুচ্ছ করিয়া উচ্চতর সাধনার ক্ষেত্র আবিষ্কার করিয়াছে। একদিকে কৃত্রিমতার একশেষ, অন্ধসংস্কারের কুপ, আটবৎসর-বয়স্ক রাসমণি দুইহস্ত-পরিমিত ঘোমটা টানিয়া দিয়া তাহার স্বামীর বাড়ীর ঘোটকটিকে দেখিয়া লজ্জায় জড়সড় হইতেছে (রাসমণির আত্মচারিত দ্রষ্টব্য)-অপরদিকে অভিসারিকা বলিতেছেনগরে ঢাক পিটিয়া ঘোষণা কর যে, আমি প্রণয়ীর প্ৰেমকলঙ্কসাগরে ডুবিয়াছি, ভালবাসা আমাকে ভয়শূন্য করিয়াছে, আমি তাহার নামের কুণ্ডল কানে পরিব ; তঁহার অনুরাগের রক্ত-তিলক ভালে পরিব, তঁহার কলঙ্ক হার করিয়া গলায় পরিব ; “কানু পরিবাদ মনে ছিল সাধ, সফল করিল বিধি”, জন্ম জন্ম আমি এই কলঙ্কের জন্য তপস্যা করিয়াছিলাম, আজি বিধাতা আমার মনের সাধ মিটাইয়াছেন । এদেশের একদিকে স্বামীর নাম লইতে ফুলের কুঁড়ির মত লজ্জাশীলার মুখ মুদিত হইয়া পডে, অপরদিকে কালী স্বামীর বুকের উপর নৃত্য করিতেছেন এবং রাধা শ্যাম-অঙ্গে পা দিয়া নিদ্রা ফাইতেছেন, “নিন্দ যায় চান্দবদনী শুঠাম অঙ্গে দিয়া পা ।” একদিকে ভক্তি ও প্রেমের বন্যা-গোরা তাহার পাগলামীর লীলাস্রোতে জগৎ ভাসাইয়া দিতেছেন, অপরদিকে রঘুনাথ শিরোমণি সুক্ষ্ম ন্যায়ের যে জাল প্ৰস্তুত করিতেছেন-সেই কুটবুদ্ধির বাগুরায় পড়িয়া জগতের বুদ্ধিমানের শিরোমণিগণ নিস্কৃতির পথ খুজিয়া পাইতেছেন না। বাঙ্গালীর চিন্তাধাবা এই স্বাধীনতা, এই কেন্দ্ৰবিহিমুখ এবং কেন্দ্ৰাভিমুখ গতি উভয়েরই ভূমাকে লক্ষ্য করিয়া ছুটতেছে। উভয়ের গতি অবাধ, উভয়েই লৌকিক গণ্ডী অতিক্ৰম করিয়া সুন্ম হইতে সূক্ষ্মতর সাধনার পথে গিয়াছে। এ যেন ঘড়ির পেণ্ডুলাম দুলিতেছে। ঘাত-প্রতিঘাত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাঙ্গালী যে ক্ষেত্র আঁকিয় দেখাইয়াছে--সেই ক্ষেত্রের কোন গণ্ডীর সীমা সে মানে নাই। উচ্চে উঠিতে তাহার নরদৃষ্টি দেবদৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। অবতরণ করিতে সে কূপ হইতে গভীরতম কূপে নিপতিত হইয়াছে তাহার। ভক্তের পা ধরিয়া বসিয়া তাহার ঈশ্বর মানভঞ্জন করিতেছেন । ধৰ্ম্মজগতে এরূপ দুঃসাহস কোন জাতি করে নাই, তথাপি এই পরিকল্পনায় অসত্যের লেশ নাই। পুত্ররূপে, পত্নীরূপে, সখ্যারূপে ভগবান তো সৰ্ব্বদাই আমাদের পা ধরিয়া বসিয়া মান ভাঙ্গাইতেছেন। এই জন্য চণ্ডীদাস বলিতেছেন-আমার ন্যায় সৌভাগ্যবতী জগতে কে আছে-বিনি