পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

seR বৃহৎ বঙ্গ স্বাধীনভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিবার অবকাশ পাইত না, আকবরের প্রেরণায় তোদরমহল ও মানসিংহ যে ভারতব্যাপী জাল প্ৰস্তুত করিয়াছিলেন, সে জালে পড়িলে আর উদ্ধারের সম্ভাবনা ছিল না। রাজস্ব ক্রমশঃ বদ্ধিত হইবে—-লুব্ধ মোগলগণ ভারতের সর্বত্র অর্থসংগ্ৰহ করিয়া তাজমহল, ময়ুর-সিংহাসন, দেওয়ানী খাস প্রস্তুত করিবেন, রাজপ্রাসাদে নরোজা উৎসব সম্পাদন করিবেন, মোগল অন্তঃপুরের বিলাসিনীদের জন্য অমূল্য হীরামাণিক্যের অলঙ্কার প্ৰস্তুত করিবেন-এই বিপুল অর্থ সংগৃহীত না লইলে প্ৰাদেশিক শাসনকৰ্ত্তাদের রক্ষা নাই ; সুতরাং রাজারা শৌৰ্য্যবীৰ্য্য হারাইয়া জমিদারে পরিণত হইলেন, সে জমিজমার যতই কেন উন্নতি হউক না, রাজস্ব-সচিবের খরদৃষ্টি এড়াইয়া তাহা আর নিরুদ্বেগে ভোগ করা তঁহাদের অসাধ্য হইবে। এই অর্থের জন্য উত্তরকালে “নরককুণ্ডে”র সৃষ্টি হইয়াছিল, ময়মনসিংহের সুকুমার রাজপুত্রদের দেহ বোত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন হইয়া রক্তপ্লাবিত হইয়াছিল,— যাহার এই পরিণাম—সেই সৰ্ব্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদেব অঙ্গীয় হইয়া দুঃখলাঞ্ছনার চূড়ান্ত ভোগ করিতে হইবে, তাহ সম্ভবতঃ পাঠান-রাজ্যাবসানে বঙ্গের রাজগণ আভাসে টের পাইয়া মরিয়া হইয়া মোগলের বিরুদ্ধে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন। আরঙ্গজেব হিন্দুদের উপর বাহ অত্যাচার করিয়াছিলেন, কিন্তু আকবর গ্ৰীতি ও সৌহার্দ্যের গিলটি কবিয়া যে সুদৃঢ় লৌহগৃঙ্খল গড়িয়াছিলেন, তাহা যাহারা স্বৰ্ণশুঙ্খল কিংবা স্বর্ণহাব বলিয়া গলায় পরিয়াছিলেন তাহারাই চিরদাসত্ব বরণ করিয়া লইয়াছিলেন । এই বারভূঞাব পতনের পর বীর বাঙ্গালীজাতির প্রকৃত শৌৰ্য্যবীৰ্য্য লুপ্ত হইল। আকববেক পবিকল্পিত সামাজ্যশক্তি-নিষ্পেষণে সেই বিক্রমবহ্নি একেবারে নির্বাপিত হইল। প্ৰচণ্ড অগ্নিদাহেব পর যেমন মাঝে মাঝে ভস্মস্তৃপের মধ্যে দুই একটা স্মৃলিঙ্গ জ্বলিয়া উঠে, তেমনি হিন্দু ও মুসলমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারদের সঙ্গে দুই একটা খণ্ডযুদ্ধের বিবরণ আমরা দেখিতে পাই। দুর্গাচরণ সান্যাল মহাশয় একটাকিয়ার জমিদারের সঙ্গে অপর কয়েকটি জমিদারের যুদ্ধ-বিগ্ৰহাদির বর্ণনা অতি কৌতুহলপ্ৰদ ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, কিন্তু এগুলি নিৰ্বাপিততেজ অনলকুণ্ডের দুই একটি ফুলিঙ্গমাত্র। মোগল-রাজপ্ৰতিনিধি বঙ্গের নবাব যে পক্ষকে আশ্রয় দিয়াছেন, সেই পক্ষের বিজয়লাভে এক মুহুৰ্ত্তও বিলম্ব হয় নাই। এই সকল আসন্ন দুঃখ-বিপদ বোধ হয় বারভূঞাগণ আভাসে উপলব্ধি করিয়াছিলেন-এজন্য তঁহাদের বংশধরগণকে সেই অজগরতুল্য সাম্রাজ্য-নীতির বদন হইতে রক্ষা করিতে যাইয়া জীবনপণ করিয়াছিলেন । এই “ভূঞা রাজাদের” পর একমাত্র সীতারাম রায় বীরত্বের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছিলেন-কিন্তু তিনি একক কি কবিবেন ? মোগলের সর্বগ্রাসী বিজয়শক্তির বিরুদ্ধে ভূষণার বীরবারের জীবনপণ-বীরত্ব তৃণের মত ভাসিযা গেল। ভূঞাদের মনে মোগলবশ্যতা যে কিরূপ দুঃসহ ছিল, তাহা ইশা খাঁর বংশধর। ( সম্ভবতঃ প্রপৌত্ৰ ) ফিরোজ খাঁর তরুণ যৌবনের কতকগুলি মনোভাবে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে। ইশা খা ছিলেন রাজপুত কালিদাসের পুত্র ; ক্ষত্রিয় রক্ত র্তাস্থার ধমনীতে বহিত। তিনি যদিও মানসিংহের সহিত বহু যুদ্ধ করিয়া অবশেষে মোগলদের সঙ্গে সখ্যসুত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন,