পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VyAP/ বৃহৎ বঙ্গ তাহা তাজমহলেও নাই। শিল্প-পণ্ডিতেরা বলিয়াছেন-তাজমহলাদি উচ্চাঙ্গের স্থাপত্যের সঙ্গে অজান্তার শিল্পের এই স্থানে প্ৰভেদ । বৌদ্ধ ও হিন্দুজগতের আধ্যাত্মিক মহিমা মোগলশিল্পে নাই। এইজন্য সৌন্দৰ্য্যের পরা কাষ্ঠ প্ৰদৰ্শন করিয়াও মোগল-শিল্প বাঙ্গালী দিগকে আকর্ষণ করিতে পারে নাই। দ্বিতীয়তঃ মোগল-শিল্পের আদব-কায়দা বাঙ্গালীর মোটেই ভাল লাগে নাই। দিল্লীশ্বর জগদীশ্বরের আসন দখল করিয়া বসিয়াছিলেন, তাহার কাছে উপস্থিত হইলে যতটা সন্ত্রম ও সতর্ক দৃষ্টির দরকার, ভক্ত দেবমন্দিরে প্রবেশ করিতেও ততটা দেখাইতে পারেন না। দৃষ্টান্তস্থলে সাজাহানের সভা, আকবরের জন্ম প্রভৃতি বিখ্যাত চিত্রের প্রতি লক্ষ্য করুন। প্রত্যেক সভাসদ ও দ্বারী চাকরী পৰ্য্যন্ত আদব-কায়দার চূড়ান্ত দেখাইতেছে, তাহাদের বসিবার ভঙ্গীতে একটুও ক্রটি নাই, পরিচ্ছদে সৰ্ব্বাঙ্গ ঘেরা। এমন কি ফকির ও সন্ন্যাসী আঁকিতে যাইয়াও র্তাহাদের ভঙ্গী বা বেশভূষায় মুহুর্তের জন্যও মোগল-শিল্পী—তাহার অতি সূক্ষ্ম ও মার্জিত আদব-কায়দার জ্ঞান ভুলিতে পারেন নাই। বাহিরের এই কায়দাকানুন, অবান্তর বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু প্ৰভৃতি সৰ্ব্ব চিত্রের মধ্যে উকি মারিতেছে। সর্বত্রই যেন রাজদরবার-বসিবার বা চলিবার ভঙ্গী পাছে বেকায়দা হইয়া যায় মোগল শিল্পী সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়াছেন। বাল্মীকি রাবণসম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, “নিষ্কম্পপত্রাস্তরবো নন্তশ্চ স্তিমিতোদকাঃ ”--“আমি যেখানে থাকি বা চলাফেরা করি সেখানে তরুগুলি নিষ্কম্প ও নদীর জল স্তিমিত গতি হইয়া যায়” ( রামায়ণ, আরণ্য, ৩৮ সৰ্গ, ৯ শ্লোক ) তদ্রুপ দিল্লীশ্বরের প্ৰবল প্ৰতাপ যেন মোগল-শিল্পকে অতি মাত্রায় স্তম্ভিত করিয়া রাখিয়াছে, সকল মূৰ্ত্তিই যেন রোমের সিনেটাবগণের মত স্থিরগম্ভীর, এরাজ্যে যেন হাসা, কঁাদা ও অঙ্গসঞ্চালন নিষিদ্ধ। এই ভাব বাঙ্গলার লোক পচ্ছন্দ করিবে কি করিয়া ? তাহদের আদর্শচাঞ্চল্য, স্থৈৰ্য্য তাহারা মোটেই পছন্দ করে না। বৌদ্ধযুগের বুদ্ধবিগ্রহে অবিচলিত স্থৈৰ্য্য আছে বটে, কিন্তু তাহার আধ্যাত্মিকতা মোগল-শিল্পে নাই। মোগল-শিল্পে সমস্ত মূৰ্ত্তিই যেন বাহ্য-দৃষ্টিতে বুদ্ধাবতার। মোগল যুগে বাঙ্গলায় হরি-সংকীৰ্ত্তনের তুমুল ধূম পড়িয়া গিয়াছিল, সংকীৰ্ত্তন-ক্ষেত্রে নৃত্যকারীদের লম্বফঝাম্প, খোলবাদক লাফাইয়া আড়াই হাত উচু উঠিয়াছে-এক পা ধরণীতলে আর এক পা বায়ুর উপর। তাহার দুই হাতের উদণ্ড গতিতে খোলের আওয়াজের উচ্চতার কল্পনা করা যায়। যেখানে বাঙ্গালী ছবি আঁকিতে বসিয়াছে, সেইখানেই ক্ষিপ্ৰগতি ও প্ৰাণের দ্রুত স্পন্দন দেখাইয়াছে ; হয়ত কোন সময়ে তাহারা মাত্ৰা অতিক্ৰম করিয়া গিয়াছে-এই নৰ্ত্তন, কুর্দন, টাকি নাড়া ও বাহাস্ফালনের দেশে, সারি সারি বুদ্ধদেবের মত প্ৰশান্ত ছবি, তাহা যতই নিপুণ-হস্ত ও সৌন্দৰ্য্যের পরিচায়ক হউক না কেন, তাহা ভাল লাগিবে কেন ? বাঙ্গালী হয়ত এককালে বৌদ্ধমূৰ্ত্তির প্রশান্ত ভাব পছন্দ করিত, কারণ তাহাতে আধ্যাত্মিক ভাব ছিল, সে যুগ চলিয়া গিয়াছিল। মোগল-শিল্পের অন্য এক সম্পদ সুন্ম রেখাঙ্কন ; মানুষের মুখ ও শরীর-অঙ্কনে তাহা এত সুন্ম অস্তদৃষ্টি দেখাইয়াছে যে, ছবি দেখিলে মনে হয়-ছবি মানুষ হইতে সুন্দর। ভোগবিলাসের রাজা সাহেন সা