পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাঙ্গলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ-আদিযুগ NSNA নাথ কিভাবে তাহার শুরু মীননাথকে কদলীপত্তনে মহিলাবর্গের প্রতি অনুচিত আসক্তি ও তজ্জনিত অপমৃত্যু হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন, তাহা বর্ণিত আছে। এই কাব্যে ফয়জুল্লা, ভবানীদাস প্ৰভৃতি কবির ভণিতা পাওয়া যায়। ৩। ধৰ্ম্মপূজার পুথি-ইহার রচয়িত রামাই পণ্ডিত ; বৌদ্ধধৰ্ম্ম শেষকালে ধৰ্ম্মপূজায় পরিণত হইয়াছিল। এই পূজার বিধিব্যবস্থাদি শূণ্যপুরাণ” ও “ধৰ্ম্মপূজা-পদ্ধতি” প্রভৃতি পুস্তকে পাওয়া যায়। এই পুস্তকদ্বয়ে অনেক ঐতিহাসিক ইঙ্গিত আছে। ৪ । গীতিকথা, রূপকথা ও পল্পী-গাথা-প্ৰাক-সংস্কৃত সাহিত্যের ইহারাই মধ্যমণিসমস্ত বঙ্গসাহিত্যের ও বাঙ্গালীজাতির গৌরব। কিছুদিন পূর্বেও ইহাদের অস্তিত্ব জানা ছিল না। রামায়ণ প্ৰভৃতি পুস্তকে দেখিতে পাওয়া যায়, রাজাদিগের সভায় রূপকথা শুনাইবার লোক ছিল । ভরত যখন দুঃস্বপ্ন দেখিয়া মৰ্ম্মপীড়িত হইয়াছিলেন, তখন র্তাহার মাতুলদের সভার “কথা বলিয়ে”র তাহার মনস্তুষ্টির জন্য নানারূপ গল্প বলিয়াছিল। শুধু রাজসভায় নহে, রাজান্তঃপুরেও কথা বলিবাব জন্য স্ত্রীলোক নিযুক্ত ছিল-ইহাদের নাম ছিল “আলাপিনী” । রাজান্তঃপুরে এই “আলাপিনী”দের প্রত্যহ কথা শুনাইতে হইত। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান অধিকারে এই শ্রেণীর লোকের উল্লেখ সর্বদা পাওয়া যাইতেছে। বৌদ্ধ পালরাজগণের সময়ে তাহদের কীৰ্ত্তিকথা ইহারা গান বঁাধিয়া শুনাইত | তাম্রশাসনে উক্ত আছে যে ধৰ্ম্মপাল (?) নিজের প্রশংসাসূচক এই সকল গান ও গল্প শুনিয়া লজ্জায় মুখাবনত করিতেন। মুসলমানরাজাদের সময়েও এই ‘কথা বলিয়ে’দের যথেষ্ট প্রভাব ছিল । আলিবর্দী খাঁর সম্বন্ধে মুতক্ষরিনে লিখিত আছে যে, তিনি প্ৰত্যহ একটা নির্দিষ্ট সময়েই এই গল্পকারীদের মুখে গল্প শুনিতেন । মীরজাফরের পুত্র মীরন যেদিন ঘোর অন্ধকার ও ঝড়বৃষ্টি-পূর্ণ নিশীথে আজিমগঞ্জের নিকট গভী" অরণ্যে স্বীয় ক্ষুদ্র শিবিরে বজ্রাঘাতে প্ৰাণত্যাগ করেন, তখনও তঁহার সঙ্গে দুইটি গণিকা ও গল্প বলিবার জন্য একজন “আলাপিনী।” ছিল। এই গল্পকারিক ও সেই বজাঘাতে প্ৰাণত্যাগ করে, গোলাম হুসেন এই উপলক্ষে একটা ফারসী শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া বুঝাইয়াছেন, যে ব্যক্তি দুষ্টের সঙ্গে থাকে সেও সেই দুষ্টের গতি প্ৰাপ্ত হয়। আরঞ্জোবও রাজসভার গল্পকারক ও আলাপিনীদের পদ বজায় রাখিয়াছিলেন । এই সকল “আলাপিনী” ও গল্পকারক রাজা ও রাজতুল্য সন্ত্রান্ত ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রাসাদে নিযুক্ত হইত, সুতরাং সুকৌশলে গল্প করার নীতি তাহদের শিক্ষা করিতে হইত। রাজাদের আশ্রয়ে এতদ্দেশে যেরূপ অপুৰ্ব্ব চারুশিল্প গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই গল্প বলিবার ভঙ্গী, বিষয়বৰ্ণন, চরিত্র, মূল ঘটনার বিবৃতি—গল্পকারীরা সেইরূপই আশ্চৰ্য্য কৌশলের সঙ্গে শিখিয়াছিল। এই গল্পের মধ্যে বৌদ্ধ জাতকের আশ্চৰ্য্য আত্মত্যাগ, হিন্দুর নিষ্ঠা, পাতিব্ৰত্য এবং নরনারীর বিবিধ আদর্শগুণ এরূপ মনোরম ভাবে ফুটিয়া উঠিত, যাহার তুলনা ভদ্রসাহিত্যেও বিরল। অথচ এক একটি গল্পে অফুরন্ত পরিহাস-রস এবং বালকের মনোরজনের উপযোগী উপাদানও থাকিত । কথাগুলির অধিকাংশই গদ্য, মাঝে মাঝে গান থাকিত