পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাঙ্গলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ-আদিযুগ 2ܠܠ পল্লীগীতিকাগুলির কতটা আদর বর্তমানে বাঙ্গলা দেশে হইবে, তদ্দারা বুঝা যাইবে বাঙ্গালী তাহার ভবিষ্যৎ গড়িবার কতটা শক্তি রাখে। এই পল্লীগাথাগুলির সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে (৩৮৪-৪০২ পৃঃ) একবার আলোচনা করিয়াছি। মলুয়া, মহুয়া, চন্দ্রাবতী, রাণী কমলা, বণিক দুহিতা কমলা, দেওয়ানা মদিন, মঞ্জর মা, ভেলুয়া, নছর মালুম, মুরস্নেহ ও কবর, আন্ধা বন্ধু, শুষ্ঠােমরায় প্রভৃতি গাথা উৎকৃষ্ট । আমরা বড় বড় কাব্য ও পুরাণে দুই চারিটি প্ৰধান নায়িকা পাই। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, গাথাগুলির প্রায় প্রত্যেকটি স্বীয় দশ বার পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে এক একটি অমর আলেখ্যের সৃষ্টি করিয়াছে। ইতিহাসবিশ্রুত ভারতের সাবিত্রী, সীতা, শকুন্তলা, দময়ন্তী, দ্ৰৌপদী প্রভৃতির পার্শ্বে বঙ্গীয় গাথাগুলির নায়িকার এক পঙক্তিতে স্থান লইতে পারেন। বসোরার বাগানের গোলাপের মত এই গাথাসাহিত্যে আদর্শ নারীগণ অফুরন্ত । ইহার একছাঁচে ঢালা নহেন। পাতিব্ৰত্যই ইহাদের একমাত্র আদশ নহে, অনেক স্থলেই ব্ৰাহ্মণ্যবিধি লজিঘত এবং শু্যামরায়, আন্ধা বন্ধু প্ৰভৃতি পালায় পাতিব্ৰত্যকে আড়ালে ফেলিয়া একনিষ্ঠ প্ৰেম তাহার বিজয়ী ধ্বজ উত্তোলিত করিয়াছে। ইহারা সামাজিক নিন্দ-প্ৰশংসা দ্বারা তিলমাত্রও বিচলিত হন নাই। হিন্দু-সাহিত্যের সহিত অভ্যস্ত পাঠক চমৎকৃত হইয়া দেখিবেন এই গাথাকথিত মহিলাব সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ছাচে ঢালা, অথচ ইহার কোন স্থানেই স্বভাবকে অতিক্রম করেন নাই। এমন কি আন্ধা বন্ধুর পালায় যখন লাজকুমাবী স্বামীকে বলিয়া কহিয়া ভঁাহার রাজ-প্ৰাসাদের শয্যাত্যাগ করিয়া একটা অন্ধ ভিক্ষুকের জন্য প্রেমের মাল্যহস্তে নিভীকভাবে চলিয়া গেলেন তখনও তাহার প্রতি দোষারোপ করার প্রবৃত্তি হয় না। মনে হয় যেন বিশুদ্ধ একখানি স্বর্ণপ্রতিমার মত প্রেমের দেবতা বিস্ময় উৎপাদনা করিয়া চলিয়া যাইতেছেন। মন্ত্রতন্ত্র, সামাজিক বিধি এই নৈসৰ্গিক খাটি নিষ্ঠার কাছে যেন ফুৎকারে উড়িয়া গেল। সহজিয়ারা যে পরকীয়া প্রেমের আদর্শ গঠন করিয়াছিলেন, তাহা বাঙ্গলার হাওয়ায় স্বতঃস্ফুৰ্ত্ত, স্বাধীন ও একনিষ্ঠ প্রেমিকদের এই সকল ছবি দেখিয়া । গাথা-ৱাচকের সংসার পর্য্যন্ত সীমা-রেখা চিহ্নিত করিয়াছেন, সহজিয়ারা সেই চিহ্ন ডিঙ্গাইয়া যাইয়া ইহাদের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া বলিয়াছেন-তোমরা ইহাদিগকে মাটীর মানুষ মনে করিয়াছ, কিন্তু ইহারাই স্বর্গের অধিবাসী ; এইরূপ সমাজ-ভোলা সাহসিক প্ৰেমই ভগবানকে পাইবার একমাত্র পন্থা-“ব্ৰহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন, কেহ না চিহ্নয়ে তারে, প্রেমের আরতি যেজন জানিয়ে-সেই সে চিনিতে পারে”-চণ্ডীদাস। ইহাদের হৃদয়ের নিৰ্ম্মল, যুথিকা শুভ্ৰ সাধুত্ব এবং তপস্যা ও কষ্ট সহিবার অসীম শক্তি দর্শনে স্বতঃই হৃদয়ের অর্ঘ্য ইহাদের পায় দিতে ইচ্ছা হয়,-ইহাদের সমাজনিন্দিত দুঃসাহসিক কৰ্ম্মের জন্য অভিযোগের ভাষা মুখে আসিয়া ফিরিয়া যায়। এই গাথা-সাহিত্যে বাঙ্গলার সমাজ, রাজনৈতিক অবস্থা, ভৌগোলিক তত্ত্ব, আচার-ব্যবহার, বাণিজ্য-শিল্প প্রভৃতি নানাবিষয়ের যে উদাহরণ পাওয়া যায়, তাহা ঐতিহাসিকের পক্ষে অমূল্য। প্ৰবচন-ডাক ও খনার বচন সম্বন্ধে পুর্বেই আলোচনা করা গিয়াছে। ( S) t-Sv পৃষ্ঠা )।