পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 বৃহৎ বঙ্গ “গামছামোড়া” সকলেই মায়ের সন্তান। যে জন যে ব্যবসায় করিবে, সেই কালীকে মা বলিয়া পূজা দিয়া যায়। আমি একখানি খড়গ দেখিয়াছিলাম, তাহার উপর কালীর ক্ষুদ্র একখানি ধাতব মূৰ্ত্তি। সেই মূৰ্ত্তির নাম “ডাকাইত কালী”। মাতা সন্তানের কলঙ্ক নিজে লইয়া কলঙ্কিত হইয়াছেন, তথাপি সন্তানকে ছাড়েন নাই। বাঙ্গলাদেশে সপ্তদশ শতাব্দীর পর হইতে শাক্তধৰ্ম্ম বাঙ্গালীর গাৰ্হস্থ্যের অঙ্গীয় হইল, সে কথা পরে বলা যাইবে । এখানে মাত্র এই বলা উচিত যে প্ৰাক-সংস্কৃত সাহিত্যে চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গলের যে খসড়া প্ৰস্তুত হইযাছিল, বিজয় গুপ্ত, বংশীদাস, নারায়ণ দেব ও ক্ষেমানন্দ একদিকে, অপর দিকে কবিকঙ্কণ, মাধবাচাৰ্য্য ও জয়নারায়ণ তাহাই কবিত্বমণ্ডিত করিয়াছিলেন। নবম শতাব্দী এমন কি তৎপূর্ববৰ্ত্তী সময়ের খসড়ার উপর। পরবর্তী বঙ্গীয় কবিরা বারবার তুলি চালাইয়াছেন, তজ্জন্য শেষের কাব্যগুলির ত্বকৃ-মাংস ব্রাহ্মণ্যযুগের হইলেও উহাদের অস্থিপঞ্জির সেই আদি যুগের। চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গল যে প্রাগ ব্ৰাহ্মণ্য যুগের খসড়া, তাহার প্রধান প্ৰমাণ এই যে নায়ক-নায়িক নিম্নশ্রেণীর লোক এবং এই দুই পুস্তকের কোনটিতেই ব্ৰাহ্মণকে সমুচিত সন্মান দেওয়া হয় নাই ! এই কাব্যগুলির নায়ক-নায়িকারা আদেী সংস্কৃত অলঙ্কার-শাস্ত্রের লক্ষণাক্রোন্ত নহে। উক্ত শাস্ত্ৰানুসারে নায়ক ব্ৰাহ্মণ কি ক্ষত্ৰিয়কুলোদ্ভূত হইবেন, তিনি বিদ্বান ও সর্বগুণসম্পন্ন হইবেন ; কিন্তু এই কাব্যগুলির মধ্যে চণ্ডীমঙ্গলের নায়ক ব্যাধ কালকেতু, সে তো প্ৰিয়দৰ্শন আদৌ নহে, বরং কুগ্ৰী-“গ্রাসগুলি তোলে যেন তেআঠিয়া তাল। ভোজন কুৎসিত বীরের শয়ন বিকার।” পণ্ডিত হওয়া দূরে থাকুক। সে হস্তিমূখী, ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় তো সে নাহোঁই-ঘূণিত ব্যাধ,-যাহার গৃহে প্ৰবেশ করিবে তাহার “উচিত হয় স্নান ।” চণ্ডীমঙ্গলে ব্ৰাহ্মণগণের অবস্থা এত শোচনীয় যে, একজন পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণ মত-বিরুদ্ধ কথা বলিয়াছিল, এজন্য বেণে ধনপতি “নফরে আদেশ করি মারে তারে ধাকা” ( মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্য )। কথা হইতে পারে, চণ্ডীমঙ্গল-রচয়িতা মুকুন্দরাম প্ৰভৃতি কবি প্ৰাচীন কবিদের খসড়াটা বদলাইয়া ফেলিলেন না কেন ? কেন তাহ আলঙ্কারিকদের মতানুসারে নূতন ছাঁচে ঢালিলেন না ? উত্তর, এই সকল কাব্য যুগ-যুগ ধরিয়া উৎসব-উপলক্ষে চণ্ডীমণ্ডপে গাওয়া হইত, সেগুলির আখ্যানবস্তু নূতন হইলে জন-সাধারণ সেই অনভ্যস্ত কথা শুনিবে কেন ? কিন্তু তথাপি নব-ব্ৰাহ্মণ্যের একজন প্ৰধান পাণ্ডা মুকুন্দরাম একেবারে নীরব হইয়া প্ৰাচীন গল্পের উপর হাত বুলাইয়া যান নাই। খুল্লনার সঙ্গে ধনপতির হাস্যপরিহাস ও রসিকতা এবং তাহার বেশী বয়সে বিবাহ-তিনি বাদ দিতে পারেন নাই। সেগুলি শ্রোতারা চিরকাল উপভোগ করিয়া আসিতেছিল, কিন্তু কবি তাহার সমস্ত আক্রোশ জনাৰ্দন ঘটকের মুখে ব্যক্তি করিয়া খুল্লনার পিতা লক্ষপতি কেন অষ্টম বৎসর বয়সে মেয়েকে গৌরীদান না কবিয়া ‘ধাড়ি’ করিয়া রাখিয়াছেন, এজন্য র্তাহাকে খুব তীব্র ভৎসনা করিয়া মনের ঝাল মিটাইয়াছেন। ভারতচন্দ্র সংস্কৃতের গোড়া। তিনি অলঙ্কারশাস্ত্রের অপলাপ করিতে কিছুতেই স্বীকার করেন নাই। এজন্য তিনি ব্যাধের ছেলে ও বেণের ছেলেকে কাব্য-নায়ক না করিয়া তদীয়