পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఏb বৃহৎ বঙ্গ রসময় দাস ও অপর কয়েকজন কবি জয়দেবের গীতানুবাদের পয়ারানুবাদ করিয়াছিলেন, কিন্তু পরবর্তী (১৭৩৬ খৃঃ) অনুবাদক গিরিধর জয়দেবের ছন্দের মাধুৰ্য্য বজায় রাখিয়া অনুবাদ প্ৰণয়ন করেন, তাহাতে জয়দেবের ঠিক সুরটি ধরা পড়িয়াছে। ১৬৩৮ খৃঃ অব্দে সৈয়দ আলোয়াল মলিক মহম্মদ জ্যোসি রচিত হিন্দী পদ্মাবতের যে বঙ্গীয় পদ্যানুবাদ করেন তাহা শুধু অনুবাদ বলিলে তৎপ্রতি অবিচার করা হয়। বাঙ্গলা ‘পদ্মাবতে’ আলোয়াল যে অসাধারণ পাণ্ডিত্য, কবিত্ব-“শক্তি, হিন্দুর পূজা-পাৰ্ব্বণের জ্ঞান এবং সংস্কৃতের উপর অধিকার প্রদর্শন করিয়াছেন তাহ অতীব বিস্ময়কর। ভারতচন্দ্রের বহুপূর্বে আলোয়াল বঙ্গভাষায় সংস্কৃত ও প্ৰাকৃত ছন্দের যে ঐশ্বৰ্য্যের পরিচয় দিয়াছেন, তাহ অপ্ৰত্যাশিতভাবে আমাদিগকে একেবারে চমৎকৃত করিয়া ফেলে। আশ্চৰ্য্যের বিষয় এই যে সংস্কৃত বহুল এই কাব্যের অনেক প্রাচীন পুথি চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফারসী অক্ষরে লিখিত দৃষ্ট হয়। সম্প্রতি কোন কোন ইংরেজের মনে বঙ্গাক্ষর রোমান অক্ষরে পরিবর্তন করিবার কথা উদয় হইয়াছে, কিন্তু তাহা হইবার নহে। পালি ভাষাটা দেবনাগব। অক্ষর ছাড়িয়া রোমান অক্ষর গ্ৰহণ করিয়াছে। সংস্কৃতের অতি সন্নিহিত পালি ভাষার এই বেশ-পরিবর্তন আমরা একেবারেই অনুমোদন করি না। তাই বলিয়া তাহারা সংস্কৃত, বাঙ্গল এবং অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার উপর এই জুলুম চালাইতে সফল হইবেন, এমন বোধ হয় না । প্ৰত্যেক বিষয়ে জাতীয়তার একটা দিক আছে। বাঙ্গলায় তিনটা ‘শ,” তিনটা ‘র,” প্ৰভৃতির কোন উপযোগিতাই নাই। সাহেবেরা এদেশে আসিয়া গরম বস্ত্ৰ ছাড়িয়া এখানকার উপযোগী ধুতি চাদর পরেন না, দেহটা গ্রীষ্মকালে ঘৰ্ম্মে সিক্ত করিয়া নিদারুণ কষ্ট সহ করেন, তবু গরম কাপড় ছাড়েন না। বাঙ্গলা অক্ষরে যত অল্প পরিসর স্থানের মধ্যে কথাগুলি লিখিত হয়, রোমান অক্ষরে লিখিলে তদপেক্ষা অনেক বেশী স্থানের দরকার। আর ভারতবর্ষে যে শত শত প্ৰাচীন পুথি আছে, রোমান অক্ষর প্রবৰ্ত্তিত হইলে তাহা পড়িবার লোক জুটিবে না। এই জাতীয়তা-বিরোধী প্ৰস্তাব কখনও সমর্থিত হইতে পারে না, মুসলমানেরা ফারসী অক্ষর চালাইবার যে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহার নিদর্শন চট্টগ্রাম ও শ্ৰীহট্টে কিছু কিছু আছে। আশা করি কেহ বাঙ্গলা ভাষার বুকের উপর এই শেল বিধাইতে চেষ্টা করিবেন না। বাঙ্গলার বিরাট অনুবাদ-সাহিত্যের গুণাগুণ-সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। হঠাৎ সংস্কৃতের মহাভাণ্ডার নিজের গৃহের দ্বারে উন্মুক্ত দেখিয়া বঙ্গীয় অনুবাদ-কারেরা দুহাতে শব্দ লুণ্ঠন আরম্ভ করিতে লাগিয়া গেলেন। প্ৰথম প্ৰথম বঙ্গভাষায় সংস্কৃত যোজনা বিসদৃশ হইয়াছিল ; কৃষ্ণদাস কবিরাজের “একাদণ্ড্যপবাস” “ধাত্ৰ্যশ্বখ’ প্ৰভৃতি সন্ধি-প্ৰয়োগ উৎকট । এমন কি বহু পরে রামপ্ৰসাদের “জননী জাগাঁহি জাগৃহি এবমুচিতমধুনা তব নহি নহি নহি”ও দুঃসহ। কিন্তু আলোয়ালের "মলয়সমীর সুসৌরভ সুশীতল, বিলোলিত পতি অতি রসাভাষে ; প্ৰফুল্লিত বনস্পতি, কুটিল তমালক্ৰম, মুকুলিত চুত-লতা কোরকজালে।” প্রভৃতি পদে বাঙ্গলার সঙ্গে সংস্কৃতের রাজযোটক হইয়াছে। এই ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা কৃতী ভারতচন্দ্র; তিনি সংস্কৃত দুরূহ। তোটক, ভুজঙ্গ-প্ৰয়াত প্ৰভৃতি औठcगोंविग । অনুবাদ-সাহিত্যের স্থায়ী ফল।