পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংস্কৃত প্ৰভাবান্বিত বাঙ্গলা-সাহিত্য Sb”ፃ রাজসভায় বহু ফাৰ্ব্বসী ও আরবী শব্দ ঢুকিয়াছে ; আইন ও আদালতের ভাষা। মুসলমানী ভাষার অধিকৃত হইয়াছে। ‘নিশাপতি,’ ‘মহাপাত্ৰ,’ ‘পাত্ৰ,’ ‘মণ্ডল,’ ‘মহামণ্ডল” প্ৰভৃতি পদবী কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তৎস্থলে-উজির, ওমরাহ, নাজির, চাকুলান্দার, কাজি, দেওয়ান, নায়েব, কারকুন হইতে আরম্ভ করিয়া ক্ষুদ্র সর্দার ও বীরকন্দাজ প্ৰভৃতি সমস্তই মুসলমানী শব্দ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু অত্যধিক প্রচলন হেতু পাইক ( পদাতিক ), কোটাল প্ৰভৃতি কয়েকটি হিন্দুযুগের প্রাকৃত শব্দ কথঞ্চিৎ জীবন রক্ষা করিয়া আছে। এই বিদেশী প্রভাব বঙ্গের পল্লীতে ঢুকে নাই, সেখানে চন্দ্ৰসূৰ্য্য হইতে আরম্ভ করিয়া ক্ষুদ্র মোট দীপটি পৰ্য্যন্ত হিন্দু কুটিরের সঁাঝের বাতিটা জালাইয়া রাখিয়াছে। এই নিত্যচঞ্চল রাষ্ট্রলক্ষ্মীর লীলাখেলা পদ্মানদীর উদ্দাম ক্রীডার ন্যায় এদেশের প্রাচীন বৈভব ভাঙ্গিতেছে, গড়িতেছে, কিন্তু পল্লীর কুটিরখানি নিশ্চল দীপ-শিখার ন্যায় এতদিন পৰ্য্যন্তও স্থির হইয়াছিল-সম্প্রতি পাশ্চাত্ত্য ঝডে তাহা বিকম্পিত হইতেছে। এই যে সংস্কৃত-যুগ আরম্ভ হইল, তাহার প্রধান কথা আচার ও নিয়মের প্রতিষ্ঠা! সৰ্ব্বগ্ৰাসী বৌদ্ধপ্ৰভাবের শেষ সময়ের ব্যভিচার-যাহা চীন, জাপান, ব্ৰহ্মদেশ প্রভৃতি যাবতীয বিদেশী রাজ্য হইতে আসিয়া উৎকটভাবে এদেশে তাণ্ডব করিতে ছিল,—তাহার স্থাত হইতে দেশবাসীকে বঁাচাইতে যাইয়া ব্ৰাহ্মণ স্মৃতিকারেরা সামাজিক নিয়মেব খুটিনাটি লইয়া ব্যস্ত হইলেন, খাদ্যাদিব নিয়মসম্বন্ধে খুব আঁটা আঁটি হইল। বৌদ্ধাধিকারে বিবাহসম্বন্ধে অত্যন্ত শিথিলতা ঘটিয়াছিল, খৃষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকেও জাভার রাজাবা সহোদরা বিবাহ কবিতেন, দক্ষিণাত্যের কোন কোন স্থানে ব্ৰাহ্মণগণের মধ্যে মামাত ভগিনী থাকিলে অন্যত্র বিবাহ করা সামাজিক অপরাধ বলিয়া গণ্য হইত। পুণাতে এই রীতি এখনও বিদ্যমান। উডিষ্যায় দেবরের সঙ্গে বিবাশ্ম প্ৰথা বৰ্ত্তমান ছিল। নব ব্ৰাহ্মণ্য এবিষয়ে এত আঁটা আঁটি নিয়ম বধিয়া দিল যে, বঙ্গদেশে সৰ্ব্ব শ্রেণীর মধ্যে বিবাহ ব্যাপারটা একটা সমস্যার মধ্যে দাড়াইয়াছে। কোন তিথিতে কি খাইতে হইবে-অষ্টাবিংশতিতত্ত্বে স্মাৰ্ত্ত রঘুনন্দন তৎসম্বন্ধে কঠোর বিধি প্রণয়ন করিলেন। কাশীদাস লিখিয়াছেন, যে ব্যক্তি মাঘ মাসে মূল ভোজন করে, সে ব্ৰহ্ম-হত্যাকাবীর পাপ করে। জাতিসম্বন্ধে স্মৃতিকারেরা ব্ৰাহ্মণকে উচুতে রাখিয়া অপর সর্বজাতিকে এতটা নীচে নামাইয়া দিলেন যে, বাঙ্গালী জাতি কোন অসীম সমুদ্রোখিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপগুলির মত স্বতন্ত্র হইয়া শতধা বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। দাক্ষিণাত্যে এই অসমত এখনও উৎকট ভাবে বিরাজ করিতেছে। কিন্তু বাঙ্গলা দেশ চিরকালই দুর্দান্ত-স্বাধীনতা-প্ৰিয়, সিংহকে খাচায় পুরিলে সে যেরূপ শৃঙ্খলকে দুঃসহ মনে করিয়া ছটফট করিতে থাকে, অত্যধিক ব্ৰাহ্মণ-শাসনে পীড়িত হইয়া বাঙ্গালী এই দৌবাত্ম্যের হাত হইতে নিস্কৃতি পাইতে ব্যাকুল হইল। ব্ৰাহ্মণের মন্দিরগুলি আত্মসাৎ করিয়া দেবতা দিগকে আড়াল করিয়া দাড়াইলেন, জনসাধারণ ও তাহদের দেবতার মধ্যে এক দুর্লঙ্খ্য প্রাচীর উখিত হইল। অভিমানে এদেশের অনেকে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিল।