পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চৈতন্য-যুগ কিন্তু এত ভালবাসিয়াও তিনি সময়ে সময়ে বুঝিতে পারেন না। ধাহাকে তিনি ভালবাসেন তিনি কে ? “পর কৈানু আপন, আপন কৈানু পরী-ঘর কৈানু বাহির, বাহির কৈানু ঘর। বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।” সাধক সৰ্ব্বস্ব দান করিয়াও সেই অধ্যাত্মলোকের দুজ্ঞেয় শক্তি, যাহা তাহাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে, তিনি কে, তিনি প্রকৃতই তাহাকে ভালবাসেন কি না। এসম্বন্ধে তাহার মনে কখনও কখনও দ্বিধার ভাব আসে-পূর্বোক্ত পদ তন্দ্রপ এক মুহুর্তের উক্তি। বিদ্যাপতির রাধা এইরূপ এক মুহূৰ্ত্তে বলিয়াছেন- “মাধব তুহু কৈছে কহবি মোয় ।” চণ্ডীদাসের কবিতা-বাঙ্গলার লোকের প্রাণের সুর। বহুকাল হইতে প্রেমের মৰ্ম্মবেদনা যে পল্লীগীতি সৃষ্টি করিয়া আসিয়াছে—তাহা চণ্ডীদাসের পদে ক্ষণে ক্ষণে মূৰ্ত্ত হইয়া প্ৰমাণ করে-এই কবি আমাদের কত আপনার । “চলে নীল শাড়ী নিঙাড়ী নিঙাড়ী” প্ৰভৃতি পদে সদ্যঃস্নাত পল্পীরূপসীগণের ছবি চোখের সম্মুখে ভাসিয়া যায়। এই কবির কবিতা মানুষের মনের সন্দেহজনিত তীব্ৰ কষ্ট, সর্বস্ব দেওয়া গাঢ় প্ৰেম-একেবারে বিনা সৰ্ত্তে আত্মদান ও চিরবিরহবিধুর এবং চিরমিলন-ফুৰ্ত্ত প্রেমিকের হৃদয়ের যে সকল কথা আছে, সেই সৰ্ব্বকালোপযোগী ভাবের এমন একটা ছাপ মারিয়া গিয়াছে, যাহা যতদিন বাঙ্গলাভাষা থাকিবে ততদিন থাকিবে। একদিকে সংসার, অপরদিকে স্বৰ্গ-চণ্ডীদাসের পদ-ইহাদের মিলনের সেতু, একের পরিণতি অপরে, প্ৰকৃত পক্ষে ইহাদের ছাড়াছাড়ি নাই। চণ্ডীদাসের কবিতা ধৰ্ম্মকে একটা উচ্চস্থানে রাখিয়া ভক্তকে তাহা দূর হইতে দেখায় নাই, তাহাকে একেবারে নিজের ঘরের সংলগ্ন মন্দিরের দেবতার পাদপীঠে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে ; এত সন্নিধ্যে আনিয়াছে বলিয়া সংসারের ধূলি লাগিয়া দেবমূৰ্ত্তি মলিন হইয়াছেন,-শীলতার অভাবে তাহার গায়ে কলঙ্কের ছায়া স্পর্শ করিয়াছে, এমন কথা যাহারা বলেন, তাহারা যাহাকে লইয়া আমরা নিত্য বাস করিতেছি--সেই অন্তবের দেবতাকে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জানিতে চাহেন না। চণ্ডীদাস বীরভূম নানুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, সেখানকার বাগুলি মন্দিরের তিনি পুরোহিত ছিলেন। রামী (রামতারা ) নামক এক ধোবানীর প্রেমে পড়িয়া তিনি জাতিচু্যুত হন। তঁহার ভ্রাতার নাম নকুল ছিল । তিনি স্বয়ং সুপণ্ডিত ও সুগায়ক ছিলেন এবং তাহার অনেক বন্ধু-ৰ্তাহাদের মধ্যে, একজন রাজা তাহাকে জাতে তুলিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। গৌড়েশ্বর ( সম্ভবতঃ জালালুদ্দিন ) স্বীয় বেগম সাহেবকে কবির অনুরাগিণী মনে করিয়া চণ্ডীদাসের হত্যার আদেশ দেন। একটা হাতীর উপর ওর্তাহাকে রাখিয়া তীব্র বেত্ৰাঘাতে র্তাহার মাংস উঠাইয়া ফেলিয়া গৌড়ের রাজধানীতে র্তাহাকে বধ করা হয়। কথিত আছে সেই নিষ্ঠর দৃশ্য দর্শনে বেগম সাহেবা অজ্ঞান হইয়া পড়েন এবং হৃদয়ের স্পন্দন স্থগিত হওয়াতে র্তাহারও সেই সঙ্গে মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে চণ্ডীদাসের বয়স চল্লিশের বেশী ছিল বলিয়া মনে হয় না। ইনি মৈথিল কবি বিদ্যাপতির সমসাময়িক ছিলেন। গঙ্গাতীরে উভয় কবির দেখা হইয়াছিল এবং উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ কথাবাৰ্ত্ত হইয়াছিল, অনেক প্ৰাচীন কবি তাহা লিখিয়া গিয়াছেন। আমাদের মনে হয় চণ্ডীদাস ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন। কৃষ্ণকীৰ্ত্তন তাহার তরুণ বয়সের