পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

କିଳକିତ8 বৃহৎ বঙ্গ লেখায় চৈতন্য দেবের জীবনের প্রভাব অতি সুস্পষ্ট; এইজন্য ইহার এমন একটি পৃথক পঙক্তির সৃষ্টি করিয়াছেন-যাহাতে ইহাদিগকে অন্যান্য প্রেম-সঙ্গীত-রচকদের সঙ্গে একত্ৰ একটা স্থান নির্দেশ করা উচিত নহে। ইহারা মহাকবি সন্দেহ নাই, কিন্তু বঙ্গদেশ ইহাদিগকে আর একটি নাম দিয়াছেন-যাহা ইহাদিগের গুণের বিশেষত্বের পরিচায়ক-সে সংজ্ঞাটি “মহাজন”। ইহাদেব পদে কবিত্বের শিল্পকলা অলক্ষিতে খেলিয়া গিয়াছে ; একটি পদের উল্লেখ করিব। চন্দ্ৰা কৃষ্ণকে খুজিয়া ক্লান্ত হইয়াছেন, বাধার নিষ্ঠুর ব্যবহারে হয়ত কৃষ্ণ আত্মহত্যা করিয়াছেন—এই আশঙ্কায় দূতীব মুখ শুকাইয়া গিয়াছে ; তাহার চক্ষে অবিরত অশ্রু ঝরিতেঝে, তিনি আঁচলে মুছিয়া তাহ সামলাইতে পারিতেছেন না। হঠাৎ যমুনা-কুলে “নীপহি” মূলে তিনি কৃষ্ণকে দেখিতে পাইলেন—“চুড়া এক ঠাই, বঁাশী এক ঠাই” ধূলিধূসব দেহে তিনি নদীসৈকতে লুঠিয়া পড়িয়াছেন। চন্দ্ৰা কৃষ্ণকে দেখিয়া হাতে স্বৰ্গ পাইলেন, কিন্তু গোপীর চিরাভ্যস্ত কপটতার সহিত মনের ভাব সম্পূর্ণ গোপন করিয়া ফেলিলেন । এদিকে শ্ৰীকৃষ্ণ ভাবিলেন, দূতী নিশ্চয়ই "তাঁহাকে খুজিতে আসিয়াছেন ; রাধা নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হইয় তাহাকে পাঠাইয়াছেন। তখন এত দুঃখের সুখ-সমাপ্তিতে পুলকিত হইয়া কৃষ্ণ দেহ হইতে ধূলি ঝাড়িয়া দূতীর জন্য অসহিষ্ণু হইয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ধূৰ্ত্তা চন্দ্ৰ তীহাকে দেখিয়াও তঁহাকে ছাড়াইয়া চলিয়া গেলেন ; তখন শুষ্ক-মুখে কৃষ্ণ ‘দুতি-দূতি” বলিয়া পিছন হইতে ডাকিতে লাগিলেন, কারণ রাধাকে না দেখিয়া থাকা তাহার পক্ষে অসহ্য হইঘাছিল। দূতী। উপেক্ষার ভাবে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, ‘পেছন হইতে ও ভাবে ডাকা ডাকি করিয়া অকল্যাণ করিতেছে কেন ?” “কি কহবি রে, মাধব, তুরিতহি কহ কহ ( আমার দাড়াইতে সময় নাই । হাম যাওবা আন কাজে”-“তব সনে বাত নহে মৰু সমুচিত, দোষ দেওবা সখী মাঝে ।” অন্তরে কৃষ্ণের সঙ্গ-লাভ-সুদুর্লভ সুখ-প্ৰাপ্তি, কিন্তু বাহিরে উদাসীনতা ! কবি বিলম্বিত ছন্দে এই দুই ভাবের লীলা অতি নিপুণভাবে আঁকিয়া দেখাইযাছেন। প্রথম কৃষ্ণকে ধূলি ঝাড়িয়া দূতীর জন্য প্ৰতীক্ষা-সূচক পদটির বিদ্রুতচ্ছন্দ এবং দ্বিতীয় পদটিতে দূতীর বাহ-উদাসীনতা কিন্তু কৃষ্ণ-সঙ্গের জন্য নিবিড় পিপাসা ছন্দের কৌশলে ধবা দিতেছে। দূতী যে কথা বলিতেছেন তাহাতে মনে হইবে যে, তাহার কথা বলিবার এক মুহুৰ্ত্তও অবকাশ নাই। এদিকে ছন্দটি এত বিলম্বিত যে তাঁহাতে তো ব্যস্ততা আদৌ নাই, বরং দূতীর যেন যতটা দেৱী করিতে পারেন ততই ভাল—এই ভাবটি প্ৰদৰ্শিত হইতেছে ; মুখে যাহা বলিতেছেন-ছন্দ তাহার প্রতিবাদ কবিয়া মিথ্যাটা জাজ্বল্যমান করিতেছে। “কি কহবি রে, মাধব,-তুরিতহি কহ কহহাম যাওবা আন কাজে, আমার দাড়াইবার সময় নাই”--দাড়াইবার সময় আছে। বরং আরও কিছু বেশী, নতুবা এত টানা সুদীর্ঘ ছন্দে কি জরুরী কথা বলা হয় ! কথায় যে ব্যস্ততা, সুরে তাহার উল্টা। পদটি ব্ল্যাক্স শেখদেৱৰৱ । এরূপ কৌশল বৈষ্ণব পদের অনেকগুলিতেই দৃষ্ট হইবে । পড়িতে তাহা যেরূপ বোঝা যায়-গানে তাহ আরও পরিষ্কার হয় ।