পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Уе е 8 বৃহৎ বঙ্গ পরিচায়ক । বাঙ্গলা শব্দের উচ্চারণে লঘুগুরু ভেদ নাই, তথাপি তৎপ্ৰবৰ্ত্তিত ছন্দগুলি অলঙ্কারশাস্বে অনুগত হইয়াছে, কোথাও তিলপ্রমাণ ভুল হয় নাই। এই কবিত্ব অসাধারণ, কিন্তু ইহা ছাড়া তঁহার আরও বাহাদুরী আছে। সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ যে নিয়ম করেন নাই, তাহ-অর্থাৎ, পদ্যের চরণে মিল দেওয়ার রীতি-ভারতচন্দ্ৰ বাঙ্গলায় প্ৰবৰ্ত্তিত করিয়াছেন, তিনি কঠোর পরীক্ষায় উত্তীৰ্ণ হইয়া ছন্দোবদ্ধ কবিতাগুলিকে মিল দান করিয়াছেন। আব্ব একটি প্ৰপান প্রশংসার বিষয় এই যে, এই সংস্কৃত ছন্দগুলির প্ৰবৰ্ত্তন করিবার মধ্যে কবির কোনরূপ পরিশ্রমের চিহ্ন দেখা যায় না । সুগায়কের কণ্ঠের গানোব ন্যায় এই ছন্দোবদ্ধ পদগুলি শ্রুতিমধুর ও একান্ত চিত্তাকর্ষক হইযাছে। বহু কবি ইহার পূর্বে ংস্কৃত শব্দ দ্বারা বাঙ্গলা কাব্যের শোভাবৃদ্ধির চেষ্টা করিয়াছেন, তাহাদের অনেকের চেষ্টায়ই কবিব যে গলদঘৰ্ম্ম হইয়া গিয়াছেন, তাহা বুঝিতে পাবা যায়, কিন্তু ভারতচন্দ্রের ভাষায় সংস্কৃত ও বাঙ্গলার অতি সহজ মিলন হইযাছে । সংস্কৃত শব্দ ও ছন্দগুলি যে ভিন্ন ভাষার, তাহ এই বাঙ্গল কাব্য পডিযা মোটেই মনে হয় না। ইনি ভাষাসম্বন্ধে সংস্কৃত যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, কেহ ইহার কাব্যগুলিকে “ভাষার তাজমহল’ সংজ্ঞা দিয়াছেন । ইনি সংস্কৃত ছন্দেব অনুরোধে প্ৰাকৃত শব্দগুলিকে অনেক সময়ে সংস্কৃতাত্মিক করিয়াছেন।--স্থা “ছলচ্ছল কালক্কল টল ট্রল তঞ্চঙ্গা।” প্ৰবাহ, নিক্কণ ও নিৰ্ম্মলতা —এই ত্ৰিগুণবোধক শব্দদ্বারা কবি একটি ছত্ৰে গঙ্গার বর্ণনা করিয়াছেন । এস্থানে সংস্কৃতাত্মিক করিবার জন্য তিনি বাঙ্গলা ছলছল ', ‘কলকল’, ‘টলটল’ এই তিনটি শব্দকে কিঞ্চিৎ রূপান্তরিত কবিয়া ব্যবহার করিয়াছেন । ভারতচন্দ্রের রচনা কখনও কখনও এইভাবে বাঙ্গলা পদগুলিতে সংস্কৃতের মোহর অঙ্কিত করিয়া নবপ্রশ্ৰী প্ৰদান করিয়াছে ! বিদ্যার রূপবর্ণনা প্ৰভৃতি কতকগুলি বিষযে সংস্কৃতের ভূত তাহার মাথায় চাপিয়া গিয়াছিল, অলঙ্কারের দৌরাত্ম্যে রচনা উদ্ভট হইয়াছে। অতিশয় ভাল করার চেষ্টা। এইভাবে বিড়ম্বিত হইয়াছে। ভারতচন্দ্ৰ কোন গৌরবান্বিত চরিত্র, কোন করুণ মৰ্ম্মম্ভদ ঘটনা, কোন মৰ্ম্মস্পর্শী কাহিনী বৰ্ণনা করিতে পারেন নাই-কিন্তু ভাষা-সম্পদে, সাধারণ কোন আখ্যায়িকা-বৰ্ণনে, পরিহাস-রসিকতায় তিনি প্রাচীন কবিগণেব মধ্যে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ । তঁহার অনেক কবিতা সহজ কথাবা এরূপ গভীর অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক যে তাহা বাঙ্গলায় প্রবাদ-বচনের ন্যায় হইয়া আছে। ভারতচন্দ্রের সমকালবৰ্ত্তী রামপ্ৰসাদ । বিদ্যাসুন্দর-বচনায় রামপ্রসাদ ভারতের গুরু। ভারতের এমন কোন উচ্চভােব নাই, এমন কোন অলঙ্কার নাই, যাহা রামপ্রসাদ পূর্বে লিখেন নাই ; কিন্তু ভাষার লালিত্যের দ্বারা ভারতের কাব্য রামপ্ৰসাদের f의 71 মৌলিকত্বকে একেবারে আড়াল করিয়া দাড়াইয়াছে। রামপ্রসাদ বৈষ্ণবদের ভাব চুরি করিয়া কঠোর শাক্তধৰ্ম্মকে যে কোমল শ্ৰী প্ৰদান করিয়াছেন, বাঙ্গলার শাক্তধৰ্ম্মেব এখন তাহাই বিশেষত্ব হইয়া দাড়াইয়াছে। সাক্ষাৎ শক্তিরূপিণী দশভূজা বাঙ্গলার ঘরে ঘরে পাশ, অঙ্কুশ খেটক, ধনু, অসি, চক্র, শূল প্ৰভৃতি আয়ুধ-ধারিণী হইয়াও বাৎসল্যের প্রতিমূৰ্ত্তি হইয়াছেন। যাহার পদতলে সিংহ ও অসুর, জটাজুট নাগিনী—সেই