পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৬
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

ফেলিয়াছে; অতলস্পর্শ অন্ধকারের সমুদ্রের মধ্যে সে পড়িয়া গিয়াছে; ক্রমেই ডুবিতেছে, ক্রমেই নামিতেছে, মাথার উপরে অন্ধকার ক্রমেই বাড়িতেছে, পদতলে ভূমি নাই, চারিদিকে কিছুই নাই, আশ্রয়, উপকূল, জগৎ-সংসার ক্রমেই দূর হইতে দূরে চলিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন, একটু একটু করিয়া তাহার সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড ব্যবধান আকাশের দিকে উঠিতেছে। তাহার ওপারে কত কি পড়িয়া রহিল। প্রাণ যেন আকুল হইয়া উঠিল। যেন ওপারের সকলি দেখা যাইতেছে; সেখানকার সূর্য্যালােক, খেলাধূলা, উৎসব সকলি দেখা যাইতেছে; কে যেন নিষ্ঠুর ভাবে, কঠোর হস্তে তাহাকে ধরিয়া রাখিয়াছে, তাহার কাছে বুকের শিরা টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেও সে যেন সে দিকে যাইতে দিবে না। বিভা যেন আজ দিব্য চক্ষু পাইয়াছে; এই চরাচরব্যাপী ঘন ঘাের অন্ধকারের উপর বিধাতা যেন বিভার ভবিষ্যৎ অদৃষ্ট লিখিয়া দিয়াছেন, অনন্ত জগৎসংসারে একাকী বসিয়া বিভা যেন তাহাই পাঠ করিতেছে; তাই তাহার চক্ষে জল নাই, দেহ নিস্পন্দ, নেত্র নির্ণিমেষ। রাত্রি দুই প্রহরের পর একটা বাতাস উঠিল; অন্ধকারে গাছপালাগুলা হা হা করিয়া উঠিল। বাতাস অতিদূরে হূ—হূ করিয়া শিশুর কণ্ঠে কাঁদিতে লাগিল। বিভার মনে হইতে লাগিল যেন দূর—দূর-দূরান্তরে সমুদ্রের তীরে বসিয়া বিভার সাধের, স্নেহের, প্রেমের শিশুগুলি দুই হাত বাড়াইয়া কাঁদিতেছে, আকুল হইয়া তাহারা বিভাকে ডাকিতেছে, তাহারা কোলে আসিতে চায়, সম্মুখে তাহারা পথ দেখিতে পাইতেছে না; যেন তাহাদের ক্রন্দন এই শত যােজন, লক্ষ যােজন গাঢ় স্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করিয়া বিভার কানে আসিয়া পৌঁছিল। বিভার প্রাণ যেন কাতর হইয়া কহিল, “কেরে, তােরা কে, তােরা কে কাঁদিতেছিস্, তােরা কোথায়!” বিভা মনে মনে যেন এই লক্ষ যােজন অন্ধকারের পথে একাকিনী যাত্রা করিল। সহস্র বৎসর ধরিয়া যেন অবিশ্রান্ত ভ্রমণ করিল, পথ শেষ হইল