পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৪
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

উপরে ঘষিব, তোর মুখে চূণ কালি মাখাইয়া সহর হইতে বাহির করিয়া দিব, তবে জলগ্রহণ করিব!”

 রুক্মিণী কিয়ৎক্ষণ অনিমেষ নেত্রে সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া শুনিল, ক্রমে তাহার দাঁতে দাঁতে লাগিল, ঠোঁটে ঠোঁট চাপিল, তাহার হাতের মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ হইল, তাহার ঘন কৃষ্ণ ভ্রূযুগলের উপর মেঘ ঘনাইয়া আসিল,তাহার ঘন-কৃষ্ণ চক্ষু-তারকায় বিদ্যুৎ সঞ্চিত হইতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর নিস্পন্দ হইয়া গেল; ক্রমে তাহার স্থূল অধরোষ্ঠ কাঁপিতে লাগিল, ঘন ভ্রূ তরঙ্গিত হইল, অন্ধকার চক্ষে বিদ্যুৎ খেলাইতে লাগিল, কেশরাশি ফুলিয়া উঠিল, হাত পা থর থর করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল। একটা পৈশাচিক অভিশাপ, একটা সর্ব্বাঙ্গস্ফীত কম্পমান হিংসা সীতারামের মাথার উপরে যেন পড়ে পড়ে। সেই মুহূর্ত্তে সীতারাম কুটীর হইতে বাহির হইয়া গেল। ক্রমে যখন রুক্মিণীর মুষ্টি শিথিল হইয়া আসিল, দাঁত খুলিয়া গেল, অধরোষ্ঠ পৃথক হইল, কুঞ্চিত ভ্রূ প্রসারিত হইল, তখন সে বসিয়া পড়িল, কহিল, “বটে! যুবরাজ তোমারই বটে। যুবরাজের বিপদ হইয়াছে বলিয়া তোমার গায়ে বড় লাগিয়াছে—যেন যুবরাজ আমার কেহ নয়। পোড়ারমুখো, এটা জানিস্ না সে যে আমারই যুবরাজ, আমিই তাহার ভাল করিতে পারি আর আমিই তাহার মন্দ করিতে পারি। আমার যুবরাজকে তুই কারামুক্ত করিতে চাহিস্। দেখিব কেমন তাহা পারিস্।”

 সীতারাম সেই দিনই রায়গড়ে চলিয়া গেল।

 বিকালবেলা বসন্তরায় রায়গড়ের প্রাসাদের বারান্দায় বসিয়া রহিয়াছেন। সম্মুখে এক প্রশস্ত মাঠ দেখা যাইতেছে। মাঠের প্রান্তে খালের পরপারে একটি আম্রবনের মধ্যে সূর্য্য অস্ত যাইতেছেন। বসন্তরায়ের হাতে তাঁহার চিরসহচর সে সেতারটি আর নাই। বৃদ্ধ সেই অস্তমান সূর্য্যের দিকে চাহিয়া আপনার মনে গুন্ গুন্ করিয়া গান গাহিতেছেন।