পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫০
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

 বসন্তরায় অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, অবশেষে বিভার হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে গাহিয়া উঠিলেন—

“আমি শুধু রৈনু বাকি!”

 বসন্তরায় প্রতাপাদিত্যের কাছে গিয়া নিতান্ত মিনতি করিয়া কহিলেন —“বাবা প্রতাপ, উদয়কে আর কেন কষ্ট দাও—সে তােমাদের কি করিয়াছে? তাহাকে যদি তােমরা ভাল না বাস’ পদে পদেই যদি সে তােমাদের কাছে অপরাধ করে—তবে তাহাকে এই বুড়ার কাছে দাও না। আমি তাহাকে লইয়া যাই—আমি তাহাকে রাখিয়া দিই—তাহাকে আর তােমাদের দেখিতে হইবে না—সে আমার কাছে থাকিবে!”

 প্রতাপাদিত্য অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত ধৈর্য্য ধরিয়া চুপ করিয়া বসন্তরায়ের কথা শুনিলেন, অবশেষে বলিলেন—“খুড়া মহাশয়, আমি যাহা করিয়াছি তাহা অনেক বিবেচনা করিয়াই করিয়াছি—এবিষয়ে আপনি অবশ্যই আমার অপেক্ষা অনেক অল্প জানেন—অথচ আপনি পরামর্শ দিতে আসিয়াছেন, আপনার এ সকল কথা আমি গ্রাহ্য করিতে পারি না।”

 তখন বসন্তরায় উঠিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে আসিয়া প্রতাপাদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন—“বাবা প্রতাপ, মনে কি নাই! তােকে যে আমি ছেলেবেলায় কোলে পিঠে করিয়া মানুষ করিলাম, সে কি আর মনে পড়ে না? স্বর্গীয় দাদা যে দিন তােকে আমার হাতে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন, সে দিন হইতে আমি কি এক মুহূর্ত্তের জন্য তােকে কষ্ট দিয়াছি? অসহায় অবস্থায় যখন তুই আমার হাতে ছিলি, এক দিনও কি তুই আপনাকে পিতৃহীন বলিয়া মনে করিতে পারিয়াছিলি? প্রতাপ, বল্ দেখি, আমি তাের কি অপরাধ করিয়াছিলাম যাহাতে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে তুই আমাকে এত কষ্ট দিতে পারিলি? এমন কথা আমি বলি না যে, তােকে পালন করিয়াছিলাম বলিয়া তুই আমার কাছে ঋণী—তোদের মানুষ করিয়া আমিই আমার দাদার স্নেহ-ঋণ শােধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম।