পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৫৫

 বসন্তরায় তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে কাজ নাই—কাজ নাই!” উভয়ে চলিলেন।

 আবার কিছু দূর গিয়া কহিলেন, “একটু বিলম্ব করিলে কি চলে না?”

 সীতারাম —“না মহারাজ তাহা হইলে বিপদ হইবে!”

 “দুর্গা বল” বলিয়া বসন্তরায় প্রাসাদের বাহির হইয়া গেলেন।

 বসন্তরায় যে আসিয়াছেন, তাহা উদয়াদিত্য জানেন না। বিভা তাহাকে বলে নাই। কেন না যখন উভয়ের দেখা হইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না, তখন এ সংবাদ তাঁহার কষ্টের কারণ হইত। সন্ধ্যার পর বিদায় লইয়া বিভা কারাগার হইতে চলিয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য একটি প্রদীপ লইয়া একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতেছেন। জানালার ভিতর দিয়া বাতাস আসিতেছে, দীপের ক্ষীণ শিখা কাঁপিতেছে, অক্ষর ভাল দেখা যাইতেছে না। কীট পতঙ্গ আসিয়া দীপের উপর পড়িতেছে। এক একবার দীপ নিভ নিভ হইতেছে। একবার বাতাস বেগে আসিল—দীপ নিভিয়া গেল। উদয়াদিত্য পুঁথি ঝাঁপিয়া তাঁহার খাটে গিয়া বসিলেন। একে একে কত কি ভাবনা আসিয়া পড়িল। বিভার কথা মনে আসিল। আজ বিভা কিছু দেরী করিয়া আসিয়াছিল, কিছু সকাল সকাল চলিয়া গিয়াছিল। আজ বিভাকে কিছু বিশেষ স্নান দেখিয়াছিলেন;—তাহাই লইয়া মনে মনে আলােচনা করিতেছিলেন। পৃথিবীতে যেন তাঁহার আর কেহ নাই—সমস্ত দিন বিভাকে ছাড়া আর কাহাকেও দেখিতে পান না— বিভাই তাঁহার একমাত্র আলোচ্য। বিভার প্রত্যেক হাসিটি প্রত্যেক কথাটি তাঁহার মনে সঞ্চিত হইতে থাকে—তৃষিত ব্যক্তি তাহার পানীয়ের প্রত্যেক বিন্দুটি পর্য্যন্ত যেমন উপভােগ করে, তেমনি বিভার প্রীতির অতি সামান্য চিহ্নটুকু পর্য্যন্ত তিনি প্রাণ-মনে উপভােগ করেন। আজ তাই এই বিজন ক্ষুদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা শুইয়া স্নেহের প্রতিমা বিভার ম্লান মুখখানি ভাবিতে ছিলেন। সেই অন্ধকারে বসিয়া তাঁহার