পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৭৫

লাগিল, তিনি গান বন্ধ করিয়া বিষণ্ণমুখে কহিলেন, “কেন দাদা, আমি কাছে থাকিলে তাের কিসের অসুখ?” উদয়াদিত্য আর কিছু বলিতে পারিলেন না।

 উদয়াদিত্যকে উন্মনা দেখিয়া বসন্তরায় তাঁহাকে সুখী করিবার জন্য দিনরাত প্রাণপণে চেষ্টা করিতেন। সেতার বাজাইতেন, সঙ্গে করিয়া লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেন—উদয়াদিত্যের জন্য প্রায় তাঁহার রাজকার্য্য বন্ধ হইল। বসন্তরায়ের ভয় পাছে উদয়াদিত্যকে না রাখিতে পারেন, পাছে উদয়াদিত্য আবার যশােহরে চলিয়া যান। দিন রাত তাঁহাকে চোখে চোখে রাখেন, তাঁহাকে বলেন, “দাদা, তােকে আর সে পাষাণ হৃদয়ের দেশে যাইতে দিব না।”

 দিন কতক থাকিতে থাকিতে উদয়াদিত্যের মনের ভাবনা অনেকটা শিথিল হইয়া আসিল। অনেক দিনের পর স্বাধীনতা লাভ করিয়া সঙ্কীর্ণপ্রসর পাষাণময় চারিটি কারাভিত্তি হইতে মুক্ত হইয়া বসন্তরায়ের কোমল হৃদয়ের মধ্যে, তাঁহার অসীম স্নেহের মধ্যে বাস করিতেছেন। অনেক দিনের পর চারিদিকে গাছপালা দেখিতেছেন, আকাশ দেখিতেছেন, দিগ্‌দিগন্তে পরিব্যাপ্ত উন্মুক্ত ঊষার আলাে দেখিতেছেন, পাখীর গান শুনিতেছেন, দূর দিগন্ত হইতে হু হু করিয়া সর্ব্বাঙ্গে বাতাস লাগিতেছে, রাত্রি হইলে সমস্ত আকাশময় তারা দেখিতে পান, জ্যোৎস্নার প্রবাহের মধ্যে ডুবিয়া যান, ঘুমন্ত স্তব্ধতার প্রাণের মধ্যে বিরাজ করিতে থাকেন। যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন, যাহা ইচ্ছা করিতে পারেন, কিছুতেই আর বাধা নাই। ছেলেবেলা যে সকল প্রজারা উদয়াদিত্যকে চিনিত, তাহারা দূর দূরান্তর হইতে উদয়াদিত্যকে দেখিবার জন্য আসিল। গঙ্গাধর আসিল, ফটিক আসিল, হবিচাচা ও করিম্ উল্লা আসিল, মথুর তাহার তিনটি ছেলে সঙ্গে করিয়া আসিল, পরাণ ও হরি দুই ভাই আসিল, শীতল সর্দ্দার খেলা দেখাইবার জন্য পাঁচ জন লাঠিয়াল সঙ্গে লইয়া আসিল।