পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৬
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

প্রত্যহ যুবরাজের কাছে প্রজারা আসিতে লাগিল। যুবরাজ তাহাদের কত কি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। এখনো যে উদয়াদিত্য তাহাদিগকে ভোলেন নাই, তাহা দেখিয়া প্রজারা অত্যন্ত আনন্দিত ও বিস্মিত হইল। মথুর কহিল, “মহারাজ, আপনি যে-মাসে রায়গড়ে আসিয়াছিলেন সেই মাসে আমার এই ছেলেটি জন্মায়, আপনি দেখিয়া গিয়াছিলেন, তার পরে আপনার আশীর্ব্বাদে আমার আরো দুটি সন্তান জন্মিয়াছে।” বলিয়া সে তাহার তিন ছেলেকে যুবরাজের কাছে আনিয়া কহিল, “প্রণাম কর।” তাহারা ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিল। পরাণ আসিয়া কহিল, “এখান হইতে যশোরে যাইবার সময় হুজুর যে নৌকায় গিয়াছিলেন, আমি সেই নৌকায় মাঝি ছিলাম, মহারাজ!” শীতল সর্দ্দার আসিয়া কহিল, “মহারাজ, আপনি যখন রায়গড়ে ছিলেন, তখন আমার লাঠি খেলা দেখিয়া বক্‌সিস্ দিয়াছিলেন, আজ ইচ্ছা আছে একবার আমার ছেলেদের খেলা মহারাজকে দেখাইব। এস ত বাপধন, তোমরা এগোওত।” বলিয়া ছেলেদের ডাকিল। এইরূপ প্রত্যহ সকাল হইলে উদয়াদিত্যের কাছে দলে দলে প্রজারা আসিত ও সকলে একত্রে মিলিয়া কথা কহিত।

 এইরূপ স্নেহের মধ্যে, গাছপালার মধ্যে, আনন্দের মধ্যে, গীতোচ্ছ্বাসের মধ্যে থাকিয়া স্বভাবতই উদয়াদিত্যের মন হইতে ভাবনা অনেকটা শিথিল হইয়া আসিল। তিনি চোখ বুজিয়া মনে করিলেন, পিতা হয়ত রাগ করেন নাই, তিনি হয়ত সন্তুষ্ট হইয়াছেন, নহিলে এত দিন আর কি। কিছু করিতেন না!

 কিন্তু এরূপ চোখ-বাঁধা বিশ্বাসে বেশি দিন মনকে ভুলাইয়া রাখিতে পারিলেন না। তাঁহার দাদা মহাশয়ের জন্য মনে কেমন একটা ভয় হইতে লাগিল। যশোহরে ফিরিয়া যাইবার কথা দাদা মহাশয়কে বলা বৃথা; তিনি স্থির করিলেন একদিন লুকাইয়া যশোহরে পালাইয়া যাইব। আবার সেই কারাগার মনে পড়িল। কোথায় এই আনন্দের