পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৭৭

স্বাধীনতা, আর কোথায় সেই সঙ্কীর্ণ ক্ষুদ্র কারাগারের একঘেয়ে জীবন! কারাগারের সেই প্রতি-মুহূর্ত্তকে এক এক বৎসর রূপে মনে পড়িতে লাগিল। সেই নিরালােক, নির্জ্জন, বায়ুহীন, বদ্ধ ঘরটি কল্পনায় স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন, শরীর শিহরিয়া উঠিল। তবুও স্থির করিলেন, এখান হইতে একদিন সেই কারাগারের অভিমুখে পালাইতে হইবে। আজই পালাইব, এমন কথা মনে করিতে পারিলেন না—“একদিন পালাইব” মনে করিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলেন।

 আজ বৃহস্পতিবার, বারবেলা, আজ যাত্রা হইতে পারে না, কাল হইবে। আজ দিন বড় খারাপ। সকাল হইতে ক্রমাগত টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে। সমস্ত আকাশ লেপিয়া মেঘ করিয়া আছে। আজ সন্ধ্যাবেলায় রায়গড় ছাড়িয়া যাইতেই হইবে বলিয়া উদয়াদিত্য স্থির করিয়া রাখিয়াছেন। সকালে যখন বসন্তরায়ের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইল, তখন বসন্তরায় উদয়াদিত্যকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন, “দাদা, কাল রাত্রে আমি একটা বড় দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্নটা ভাল মনে পড়িতেছে না, কেবল মনে আছে, তােতে আমাতে যেন—যেন জন্মের মত ছাড়াছাড়ি হইতেছে।”

 উদয়াদিত্য বসন্তরায়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “না, দাদা মহাশয়!— ছাড়াছাড়ি যদি বা হয়, ত জন্মের মত কেন হইবে?”

 বসন্তরায় অন্য দিকে চাহিয়া ভাবনার ভাবে কহিলেন, “তা নয়ত আর কি! কত দিন আর বাঁচিব বল্, বুড়া হইয়াছি!”

 গত রাত্রের দুঃস্বপ্নের শেষ তান এখনাে বসন্তরায়ের মনের গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল, তাই তিনি অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিলেন।

 উদয়াদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন—“দাদা মহাশয়, আবার যদি আমাদের ছাড়াছাড়ি হয় ত কি হইবে!”