পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৯১

করিলেন। উদয়াদিত্য সমরাদিত্যকে কোলে তুলিয়া লইয়া তাহাকে চুম্বন করিলেন ও আপনার মনে কহিলেন—“বৎস, যে সিংহাসনে তুমি বসিবে, সে সিংহাসনের অভিশাপ তােমাকে স্পর্শ যেন না করে!” রাজবাড়ির ভৃত্যেরা উদয়াদিত্যকে বড় ভালবাসিত, তাহারা একে একে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল, সকলে কাঁদিতে লাগিল। অবশেষে মন্দিরে গিয়া উভয়ে দেবতাকে প্রণাম করিয়া যাত্রা করিলেন।

 শােক বিপদ অত্যাচারের রঙ্গভূমি পশ্চাতে পড়িয়া রহিল—জীবনের কারাগার পশ্চাতে পড়িয়া রহিল। উদয়াদিত্য মনে করিলেন, এ বাড়িতে এ জীবনে আর প্রবেশ করিব না। একবার পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন। দেখিলেন রক্তপিপাসু কঠোর-হৃদয় রাজবাটি আকাশের মধ্যে মাথা তুলিয়া, দৈত্যের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে। পশ্চাতে ষড়যন্ত্র, যথেচ্ছাচারিতা, রক্তলালসা, দুর্ব্বলের পীড়ন, অসহায়ের অশ্রুজল পড়িয়া রহিল, সম্মুখে অনন্ত স্বাধীনতা, প্রকৃতির অকলঙ্ক সৌন্দর্য্য, হৃদয়ের স্বাভাবিক স্নেহ মমতা তাঁহাকে আলিঙ্গন করিবার জন্য দুই হাত বাড়াইয়া দিল। তখন সবে প্রভাত হইয়াছে। নদীর পূর্ব্ব পারে বনান্তের মধ্য হইতে কিরণের ছটা ঊর্দ্ধশিখা হইয়া উঠিয়াছে; গাছপালার মাথার উপরে সােনার আভা পড়িয়াছে—লােকজন জাগিয়া উঠিয়াছে, মাঝিরা আনন্দে গান গাহিতে গাহিতে পাল তুলিয়া নৌকা খুলিয়া দিয়াছে। প্রকৃতির এই বিমল, প্রশান্ত, পবিত্র প্রভাত-মুখশ্রী দেখিয়া উদয়াদিত্যের প্রাণ পাখীদের সহিত স্বাধীনতার গান গাহিয়া উঠিল। মনে মনে কহিলেন, “জন্ম জন্ম যেন প্রকৃতির এই বিমল শ্যামল ভাবের মধ্যে স্বাধীন ভাবে বিচরণ করিতে পাই, আর সরল প্রাণদের সহিত একত্রে বাস করিতে পারি।”

 নৌকা ছাড়িয়া দিল। মাঝিদের গান ও জলের কল্লোল শুনিতে শুনিতে উভয়ে অগ্রসর হইলেন। বিভার প্রশান্ত হৃদয়ে আনন্দের উষালােক বিরাজ করিতেছিল, তাহার মুখে চোখে অরুণের দীপ্তি। সে