পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৪
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

 রামমোহনের ভাব দেখিয়া বিভা একেবারে মলিন হইয়া গিয়া কহিল —“কেন মোহন—আজ কেন যাইব না!”

 রামমোহন কহিল—“আজ সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে—আজ থাক্, মা।”

 বিভা নিতান্ত ভীত হইয়া কহিল, “সত্য করিয়া বল মোহন কি হইয়াছে?”

 রামমোহন থাকিতে পারিল না। আত্মগোপন করা তাহার অভ্যাস নাই! সেইখানেই সে বসিয়া পড়িল—কাঁদিয়া কহিল—“মা জননী, আজ তোমার রাজ্যে তোমার স্থান নাই—তোমার রাজবাটীতে তোমার গৃহ নাই। আজ মহারাজ বিবাহ করিতেছেন।”

 বিভার মুখ একেবারে পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। তাহার হাত পা হিম হইয়া গেল! রামমোহন কহিতে লাগিল, “মা, যখন তোর এই অধম সন্তান তোকে ডাকিতে গিয়াছিল, তখন তুই কেন আসিলি না, মা? তখন তুই নিষ্ঠুর পাষাণী হইয়া আমাকে কেন ফিরাইয়া দিলি মা? মহারাজের কাছে আমার যে আর মুখ রহিল না! বুক ফাটিয়া গেল, তবু যে তোর হইয়া একটি কথাও কহিতে পারিলাম না!”

 বিভা আর চোখে কিছু দেখিতে পাইল না,—মাথা ঘুরিয়া সেইখানে পড়িয়া গেল। রামমোহন তাড়াতাড়ি জল আনিয়া বিভার মুখে চোখে ছিটা দিল। কিছুকণ পরে বিভা উঠিয়া বসিল। এক আঘাতে বিভার সমস্ত জগৎ ভাঙিয়া গেছে। স্বামীর রাজ্যের মধ্যে আসিয়া, রাজধানীর কাছে পৌঁছিয়া, রাজপুরীর দুয়ারে আসিয়া তৃষার্ত্ত-হৃদয় বিভার সমস্ত সুখের আশা মরীচিকার মত মিলাইয়া গেল।

 বিভা আকুল ভাবে কহিল—“মোহন, তিনি যে আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন—আমার আসিতে কি বড় বিলম্ব হইয়াছে?

 মোহন কহিল, “বিলম্ব হইয়াছে বৈকি।”

 বিভা অধীর হইয়া কহিল—“আর কি মার্জ্জনা করিবেন না?”