পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
২১

কাজ যদি গ্রহণ কর, তবে তলোয়ার হাতে করিয়া মরিবার সাধ মিটিতেও পারে, কিন্তু সে তলোয়ার খাপ হইতে খোলা তোমার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিবে না। বুড়া হইয়া পড়িয়াছি, প্রজারা সুখে স্বচ্ছন্দে আছে, ভগবান্ করুন্, আর যেন লড়াই করিবার দরকার না হয়। বয়স গিয়াছে; তলোয়ার ত্যাগ করিয়াছি। এখন তলোয়ারের পরিবর্ত্তে আর একজন আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছে।” এই বলিয়াই পার্শ্বে শায়িত সহচরী সেতারটিকে দুই একটি ঝঙ্কার দিয়া একবার জাগাইয়া দিলেন।

 পাঠান ঘাড় নাড়িয়া চোখ বুঁজিয়া কহিল, “আহা, যাহা বলিতেছেন, ঠিক বলিতেছেন। একটি বয়েৎ আছে যে, তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়।”

 বসন্তরায় বলিয়া উঠিলেন “কি বলিলে খাঁ সাহেব? সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়, কি চমৎকার!” চুপ করিয়া কিয়ৎক্ষণ ভাবিতে লাগিলেন, যতই ভাবিতে লাগিলেন ততই যেন অধিকতর অবাক হইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে বয়েৎটির ব্যাখ্যা করিয়া বলিতে লাগিলেন, “তলোয়ার যে এত বড় ভয়ানক দ্রব্য তাহাতেও শত্রুর শত্রুত্ব নাশ করা যায় না,—কেমন করিয়া বলিব নাশ করা যায়?—রোগীকে বধ করিয়া রোগ আরোগ্য করা সে কেমনতর আরোগ্য? কিন্তু সঙ্গীত যে এমন মধুর জিনিষ, তাহাতে শত্রু নাশ না করিয়াও শত্রুত্ব নাশ করা যায়। এ কি সাধারণ কবিত্বের কথা? বাঃ, কি তারিফ্!” বৃদ্ধ এত দূর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন যে, শিবিকার বাহিরে পা রাখিয়া বসিলেন, পাঠানকে আরো কাছে আসিতে বলিলেন ও কহিলেন “তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রুকেও মিত্র করা যায়, কেমন খাঁ সাহেব?”

 পাঠান—“আজ্ঞা হাঁ হুজুর।”

 বসন্তরায়—“তুমি একবার রায়গড়ে যাইও। আমি যশোর হইতে ফিরিয়া গিয়া তোমার যথাসাধ্য উপকার করিব!”