পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

 পাঠান উৎফুল্ল হইয়া কহিল “আপনি ইচ্ছা করিলে কি না করিতে পারেন!” পাঠান ভাবিল, একরকম বেশ গুছাইয়া লইয়াছি। জিজ্ঞাসা করিল “আপনার সেতার বাজানাে আসে?”

 বসন্তরায় কহিলেন “হাঁ।” ও তৎক্ষণাৎ সেতার তুলিয়া লইলেন। আঙুলে মেজরাপ আঁটিয়া বেহাগ আলাপ করিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে পাঠান মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল “বাহবা! খাসী।” ক্রমে উত্তেজনার প্রভাবে শিবিকার মধ্যে বসিয়া থাকা বসন্তরায়ের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল। তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বাজাইতে লাগিলেন। মর্য্যাদা গাম্ভীর্য্য আত্মপর সমস্ত বিস্মৃত হইলেন ও বাজাইতে বাজাইতে অবশেষে গান ধরিলেন—“কেয়সে কাটোঙ্গী রয়ন, সো পিয়া বিনা।”

 গান থামিলে পাঠান কহিল “বাঃ কি চমৎকার আওয়াজ।”

 বসন্তরায় কহিলেন “তবে বােধ করি, নিস্তব্ধ রাত্রে, খােলা মাঠে সকলের আওয়াজই মিঠা গালে। কারণ, গলা অনেক সাধিয়াছি বটে, কিন্তু লােকে আমার আওয়াজের ত বড় প্রশংসা করে না। তবে কি না, বিধাতা যতগুলি রােগ দিয়াছেন তাহার সকল গুলিরই একটি না একটি ঔষধ দিয়াছেন, তেমনি যতগুলি গলা দিয়াছেন তাহার একটি না একটি শ্রোতা আছেই। আমার গলাও ভাল লাগে এমন দুটো অর্ব্বাচীন আছে। নহিলে, এত দিনে সাহেব, এ গলার দোকানপাট বন্ধ করিতাম; সেই দুটো আনাড়ি খরিদ্দার আছে, মাল চিনে না, তাহাদেরি কাছ হইতে বাহবা মিলে। অনেক দিন দুটাকে দেখি নাই, গীত গানও বন্ধ আছে; তাই ছুটিয়া চলিয়াছি; মনের সাধে গান শুনাইয়া, প্রাণের বােঝা নামাইয়া বাড়ি ফিরিব।” বৃদ্ধের ক্ষীণজ্যোতি চোখ দুটি স্নেহে ও আনন্দে দীপ্যমান হইয়া উঠিল।

 পাঠান মনে মনে কহিল “তােমার একটা সাধ মিটিয়াছে, গান শুনানো হইয়াছে, এখন প্রাণের বোঝাটা আমিই নামাইব কি? তােবা, তােবা,