পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
৬১

 বিভা তখন বলপূর্ব্বক উঠিয়া দাঁড়াইল। হাত পা থর্‌থর্‌ করিয়া কাঁপিতেছে। কহিল, “মামা, তুমি আর একটু এইখানে থাক। আমি একবার দাদার কাছে যাই।” বলিয়া বিভা তাড়াতাড়ি উদয়াদিত্যের শয়নকক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল।

 তখন ক্ষীণ চন্দ্র অস্ত যায় যায়। চারিদিক অন্ধকার হইয়া আসিতেছে। কোথাও সাড়াশব্দ নাই। রামচন্দ্র রায় তাঁহার শয়নকক্ষের দ্বারে দাঁড়াইয়া দেখিলেন দুই পার্শ্বে রাজ-অন্তঃপুরের শ্রেণীবদ্ধ কক্ষে দ্বার রুদ্ধ, সকলেই নিঃশঙ্কচিত্তে ঘুমাইতেছে। সম্মুখের প্রাঙ্গণে চারিদিকের ভিত্তির ছায়া পড়িয়াছে, ও তাহার এক পার্শ্বে একটুখানি জ্যোৎস্না এখনাে অবশিষ্ট রহিয়াছে। ক্রমে সেটুকুও মিলাইয়া গেল। অন্ধকার এক-পা-এক-পা করিয়া সমস্ত জগৎ দখল করিয়া লইল। অন্ধকার দূরে বাগানের শ্রেণীবদ্ধ নারিকেল গাছগুলির মধ্যে আসিয়া জমিয়া বসিল। অন্ধকার কোলঘেঁসিয়া অতিকাছে আসিয়া দাঁড়াইল! রামচন্দ্র রায় কল্পনা করিতে লাগিলেন, এই চারিদিকের অন্ধকারের মধ্যে না জানি কোথায় একটা ছুরি তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে! দক্ষিণে না বামে, সম্মুখে না পশ্চাতে? যে ইতস্তত এক একটা কোণ দেখা যাইতেছে, উহার মধ্যে একটা কোণে ত কেহ মুখ গুঁজিয়া, সর্ব্বাঙ্গ চাদরে ঢাকিয়া চুপ করিয়া বসিয়া নাই? কি জানি ঘরের মধ্যে যদি কেহ থাকে!—খাটের নীচে, অথবা দেয়ালের এক পাশে! তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল, কপাল দিয়া ঘাম পড়িতে লাগিল। একবার মনে হইল যদি মামা কিছু করেন, যদি তাঁহার কোন অভিসন্ধি থাকে? আস্তে আস্তে একটু সরিয়া দাঁড়াইলেন। একটা বাতাস আসিয়া ঘরের প্রদীপ নিভিয়া গেল। রামচন্দ্র ভাবিলেন—কে একজন বুঝি প্রদীপ নিভাইয়া দিল—কে একজন বুঝি ঘরে আছে। রমাপতির কাছে ঘেঁসিয়া গিয়া ডাকিলেন— “মামা।” মামা কহিলেন,—“কি বাবা?” রামচন্দ্র রায়, মনে মনে