পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

 প্রতাপাদিত্য দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিলেন, “পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন! প্রহরীরা গেল কোথায়?”

 মন্ত্রী পুনরায় কহিলেন, “বহির্দ্বারের প্রহরীরা পালাইয়া গেছে।”

 প্রতাপাদিত্য মুষ্টিবদ্ধ করিয়া কহিলেন “পালাইয়া গেছে? পালাইবে কোথায়? যেখানে থাকে তাহাদের খুঁজিয়া আনিতে হইবে! অন্তঃপুরের প্রহরীদের এখনি ডাকিয়া লইয়া এস!” মন্ত্রী বাহির হইয়া গেলেন।

 রামচন্দ্র রায় যখন নৌকায় চড়িলেন, তখনাে অন্ধকার আছে। উদয়াদিত্য, বসন্তরায়, সুরমা ও বিভা, সে রাত্রে আসিয়া আর বিছানায় শুইল না। বিভা একটি কথা না বলিয়া, একটি অশ্রু না ফেলিয়া অবসন্ন ভাবে শুইয়া রহিল, সুরমা তাহার কাছে বসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। উদয়াদিত্য ও বসন্তরায় চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। অন্ধকার ঘরে পরস্পরের মুখ অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাইতেছে। ঘরের মধ্যে যেন অদৃশ্য একজন কে — অন্ধকার বল, আশঙ্কা বল, অদৃষ্ট বল—বসিয়া আছে, তাহার নিশ্বাস পতনের শব্দ শুনা যাইতেছে। সদানন্দহৃদয় বসন্তরায় চারিদিকে নিরানন্দ দেখিয়া একেবারে আকুল হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি অনবরত টাকে হাত বুলাইতেছেন, চারিদিক দেখিতেছেন ও ভাবিতেছেন—এ কি হইল! তাঁহার গােলমাল ঠেকিয়াছে, চারিদিককার ব্যাপার ভালরূপ আয়ত্ত করিতে পারিতেছেন না। সমস্ত ঘটনাটা তাঁহার একটা জটিল দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইতেছে। এক একবার বসন্তরায় উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কাতর স্বরে কহিতেছেন, “দাদা!” উদয়াদিত্য কহিতেছেন “কি দাদামহাশয়?” তাহার উত্তরে বসন্তরায়ের আর কথা নাই। ঐ এক “দাদা” সম্বােধনের মধ্যে একটি আকুল দিশাহারা হৃদয়ের বাক্যহীন সহস্র অব্যক্ত প্রশ্ন প্রকাশ পাইবার জন্য আঁকুবাঁকু করিতেছে। তাঁহার বিশেষ একটা কোন প্রশ্ন নাই, তাহার সমস্ত কথার অর্থ এই—এ কি? চারিদিককার অন্ধকার