পাতা:ভারতবর্ষ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
ভারতবর্ষের ইতিহাস।
১৭

 ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি-মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, এক দল যদি বা যায়, কোথা হইতে আর-এক দল উঠিয়া পড়ে–পাঠান-মোগল, পর্ত্তুগীজ-ফরাসী-ইংরাজ, সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।

 কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্ত্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে, যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না। ভারতবাসী কোথায়—এ সকল ইতিহাস তাহার কোন উত্তর দেয় না। যেন ভারতবাসী নাই—কেবল যাহারা কাটাকাটি-খুনাখুনি করিয়াছে, তাহারাই আছে।

 তখনকার দুর্দিনেও এই কাটাকাটি-খুনাখুনিই যে ভারতবর্ষের প্রধানতম ব্যাপার, তাহা নহে। ঝড়ের দিনে যে ঝড়ই সর্ব প্রধান ঘটনা, তাহা তাহার গর্জনসত্বেও স্বীকার করা যায় না,–সে দিনও সেই ধূলিসমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্ম-মৃত্যু-সুখদুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, তাহা ঢাকা পড়িলেও মানুষের পক্ষে তাহাই প্রধান। কিন্তু বিদেশী পথিকের কাছে এই ঝড়টাই প্রধান, এই ধূলিজালই তাহার চক্ষে আর সমস্তই গ্রাস করে; কারণ, সে ঘরের ভিতরে নাই, সে ঘরের বাহিরে। সেইজন্য বিদেশীর ইতিহাসে এই ধূলির কথা–ঝড়ের কথাই পাই, ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না। সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয়, ভারতবর্ষ তখন ছিল না, কেবল মোগল-পাঠানের গর্জনমুখর বাত্যাবর্ত শুষ্কপত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর ইতে দক্ষিণে এবং পশ্চিম হইতে পূর্বে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

 কিন্তু বিদেশ যখন ছিল, দেশ তখনো ছিল, নহিলে এই সমস্ত