পাতা:ভারতবর্ষ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
ভারতবর্ষের ইতিহাস।
১৯

যে কিছু ইতিহাসকথা, তাহা ভারতবর্ষের পক্ষে বিচিত্র কুহেলিকা—তাহা স্বদেশসম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টির সহায়তা করে না, দৃষ্টি আবৃত করে মাত্র। তাহা এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে, যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে নবাবের বিলাসশালার দীপালোকে নর্ত্তকীর মণিভূষণ জলিয়া উঠে; বাদ্সাহের সুরাপাত্রের রক্তিম ফেনোচ্ছাস উন্মত্ততার জাগররক্ত দীপ্ত-নেত্রের ন্যায় দেখা দেয়—সেই অন্ধকারে আমাদের প্রাচীন দেবমন্দিরসকল মস্তক আবৃত করে এবং সুলতান-প্রেয়সীদের শ্বেতমর্ম্মরচিত কারুখচিত কবরচুড়া নক্ষত্রলোক চুম্বন করিতে উদ্যত হয়। সেই অন্ধকারের মধ্যে অশ্বের খুরধ্বনি, হস্তীর বৃংহিত, অস্ত্রের ঝঞনা, সুদুরব্যাপী শিবিরের তরঙ্গিত পাণ্ডুরতা, কিংখাব-আস্তরণের স্বর্ণচ্ছটা, মসজিদের ফেনবুদবুদাকার পাষাণমণ্ডপ, খোজাপ্রহরীরক্ষিত প্রাসাদ-অন্তঃপুরে রহস্যনিকেতনের নিস্তব্ধ মৌন—এ সমস্তই বিচিত্র শব্দে ও বর্ণে ও ভাবে যে প্রকাণ্ড ইন্দ্রজাল রচনা করে, তাহাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলিয়া লাভ কি? তাহা ভারতবর্ষের পুণ্যমন্ত্রের পুঁথিটিকে একটি অপরূপ আরব্য উপন্যাস দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে—সেই পুথিখানি কেহ খোল না, সেই আরব্য উপন্যাসেরই প্রত্যেক ছাত্র ছেলেরা মুখস্থ করিয়া লয়। তাহার পরে প্রলয়রাত্রে এই মোগল সাম্রাজ্য যখন মুমূর্য, তখন শ্মশানস্থলে দূরাগত গৃগণের পরস্পরের মধ্যে যে সকল চাতুরীপ্রবঞ্চনা-হানাহানি পড়িয়া গেল, তাহাও কি ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত? এবং তাহার পর হইতে পাঁচ পাঁচ বৎসরে বিভক্ত ছককাটা সতরঞ্চের মত ইংরাজশাসন, ইহার মধ্যে ভারতবর্ষ আরো ক্ষুদ্র;—বস্তুত সতরঞ্চের সহিত ইহার প্রভেদ এই যে, ইহার ঘরগুলি কালেয়-শাদায় সমান বিভক্ত নহে, ইহার পনেরোআনাই শাদা। আমরা পেটের অল্পের বিনিময়ে সুশাসন, সুবিচার, সুশিক্ষা, সমস্তই একটি বৃহৎ হোয়াইট্যা-