পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৴৹

বাহনচ্যুত শত্রুকে মারা অন্যায় গণ্য হ’ত। নিয়মলঙ্ঘন করলে যোদ্ধা নিন্দাভাজন হতেন। স্বপক্ষ ও বিপক্ষের আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। সূর্যাস্তের পর অবহার বা যুদ্ধবিরাম ঘোষিত হ’ত, কিন্তু সময়ে সময়ে রাত্রিকালেও যুদ্ধ চলত। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে যুদ্ধ হত, কিন্তু সৌপ্তিকপর্বে অশ্বত্থামা তার ব্যতিক্রম করেছেন। যদ্ধভূমির নিকট বেশ্যাশিবির থাকত। বিখ্যাত যোদ্ধাদের রথে চার ঘোড়া জোতা হ’ত। ধ্বজদণ্ড রথের ভিতর থেকে উঠত, রথী আহত হ’লে ধ্বজদণ্ড ধ’রে নিজেকে সামলাতেন। অর্জুন ও কর্ণের রথ শব্দহীন ব’লে বর্ণিত হয়েছে। দ্বৈরথ যাদ্ধের পূর্বে বাগ্‌যুদ্ধ হ’ত, বিপক্ষের তেজ কমাবার জন্য দুই বীর পরস্পরকে গালি দিতেন এবং নিজের গর্ব করতেন। বিখ্যাত রথীদের চতুর্দিকে রক্ষী যোদ্ধারা থাকতেন, পিছনে একাধিক শকটে রাশি রাশি শর ও অন্যান্য ক্ষেপণীয় অস্ত্র থাকত। বোধ হয় পদাতি সৈন্য ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধ করত না, তাদের বর্মও থাকত না; এই কারণেই রথারোহী বর্মধারী যোদ্ধা একাই বহু সৈন্য শরাঘাতে বধ করতে পারতেন।

 আদিপর্ব ১-পরিচ্ছেদে মহাভারতকথক সৌতি বলেছেন, ‘কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে ব’লে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরা বলবেন।’ এই শেষোক্ত কবিরা মহাভারতের ত্রুটি শোধনের চেষ্টা করেছেন। মহাভারতের দুষ্মন্ত ইচ্ছা ক’রে শকুন্তলার অপমান করেছেন, কিন্তু কালিদাসের দুষ্মন্ত শাপের বশে না জেনে করেছেন। মহাভারতের কচ দেবযানীকে প্রত্যভিশাপ দিয়েছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কচ পরম ক্ষমাশীল। কাশীরাম দাসের গ্রন্থে এবং বাংলা নাটকে কর্ণচরিত্র সংশোধিত হয়েছে।

 মহাভারতের আখ্যান ও উপাখ্যানগুলি দু-তিন হাজার বৎসর ধ’রে এদেশের জনসাধারণকে মনোরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব শিখিয়েছে এবং কাব্যনাটকাদির উপাদান যুগিয়েছে। মহাভারতের বহু শ্লোক প্রবাদরূপে সুপ্রচলিত হয়েছে। মহাভারতীয় নরনারীর চরিত্রে কোথায় কি অসংগতি বা ত্রুটি আছে লোকে তা গ্রাহ্য করে নি, যা কিছু মহৎ তাই আদর্শরূপে পেয়ে ধন্য হয়েছে। সেকাল আর একালের লোকাচারে অনেক প্রভেদ, তথাপি মহাভারতে কৃষ্ণ ভীষ্ম ও ঋষিগণ কর্তৃক ধর্মের যে মূল আদর্শ কথিত হয়েছে তা সর্বকালেই গ্রহণীয়।

 দুঃখময় সংসারে মিলনান্ত আখ্যানই লোকপ্রিয় হবার কথা, কিন্তু এদেশের প্রাচীনতম এবং সর্বাধিকপ্রচলিত চিরায়ত-সাহিত্য বা ক্লাসিক রামায়ণ-মহাভারত বিয়োগান্ত হ’ল কেন? এই দুই গ্রন্থের স্পষ্ট উদ্দেশ্য—বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা দ্বারা লোকের মনোরঞ্জন এবং কথাচ্ছলে ধর্মশিক্ষা; কিন্তু অন্য উদ্দেশ্যও আছে।