পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬২
মহাভারত

স্মিতমুখে বললেন, আমিও তাঁর প্রতি অনুরক্ত। সখা, তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব।

 উর্বশী স্নান ক’রে মনোহর অলংকার ও গন্ধমাল্য ধারণ করলেন এবং সন্ধ্যাকালে চন্দ্রোদয় হ’লে অর্জুনের ভবনে যাত্রা করলেন। তাঁর কোমল কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশপাশ পুষ্পমালায় ভূষিত, মুখচন্দ্র যেন গগনের চন্দ্রকে আহ্বান করছে, চন্দনচর্চিত হারশোভিত স্তনদ্বয় তাঁর পাদক্ষেপে লম্ফিত হচ্ছে। অল্প মদ্যপান, কামাবেশ ও বিলাসবিভ্রমের জন্য তিনি অতিশয় দর্শনীয়া হলেন। দ্বারপালের মুখে উর্বশীর আগমনসংবাদ পেয়ে অর্জুন শঙ্কিতমনে এগিয়ে এলেন এবং লজ্জায় চক্ষু আবৃত ক’রে সসম্মানে বললেন, দেবী, নতমস্তকে অভিবাদন করছি বলুন কি করতে হবে, আমি আপনার আজ্ঞাবহ ভৃত্য। অর্জুনের কথা শুনে উর্বশীর যেন চৈতন্যলোপ হ’ল। তিনি বললেন, নরশ্রেষ্ঠ চিত্রসেন আমাকে যা বলেছেন শোন। তোমার আগমনের জন্য ইন্দ্র যে আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন তাতে দেবতা মহর্ষি রাজর্ষি প্রভৃতির সমক্ষে গন্ধর্বগণ বীণা বাজিয়েছিলেন, শ্রেষ্ঠ অপ্সরারা নৃত্য করেছিলেন। পার্থ, সেই সময়ে তুমি নাকি অনিমেষনয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে। সভাভঙ্গের পর তোমার পিতা ইন্দ্র চিত্ররথকে দিয়ে আমাকে আদেশ জানালেন, আমি যেন তোমার সঙ্গে মিলিত হই। এই কারণেই আমি তোমার সেবা করতে এসেছি। তুমি আমার চিরাভিলষিত, তোমার গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে আমি অনঙ্গের বশবর্তিনী হয়েছি।

 লজ্জায় কান ঢেকে অর্জুন বললেন, ভাগ্যবতী, আপনার কথা আমার শ্রবণযোগ্য নয়, কুন্তী ও শচীর ন্যায় আপনি আমার গুরুত্নীতুল্য। আপনি পুরু বংশের জননী[১], গুরুর অপেক্ষাও গুরুতরা, সেজন্যই উৎফুল্লনয়নে আপনাকে দেখেছিলাম। উর্বশী বললেন, দেবরাজপুত্র আমাকে গুরুস্থানীয়া মনে করা অনুচিত, অপ্সরারা নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র যেকেউ স্বর্গে এলে আমাদের সঙ্গে সহবাস করেন। তুমি আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর। অর্জুন বললেন, বরবর্ণিনী, আমি আপনার চরণে মস্তক রাখছি, আপনি আমার মাতৃবৎ পূজনীয়া, আমি আপনার পুত্রবৎ রক্ষণীয়। উর্বশী ক্রোধে অভিভূত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভ্রুকুটি ক’রে বললেন, পার্থ, আমি তোমার পিতার অনুজ্ঞায় স্বয়ং তোমার গৃহে কামার্তা হয়ে এসেছি তথাপি তুমি আমাকে আদর করলে না; তুমি সম্মানহীন


  1. পুরুরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে আয়ু জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর প্রপৌত্র পুরু।