পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বনপর্ব
১৬৯

 পুষ্করের শাসনে কোনও লোক নল-দময়ন্তীর সমাদর করলে না। তাঁরা কেবল জলপান ক’রে নগরের উপকণ্ঠে ত্রিরাত্র বাস করলেন। ক্ষুধার্ত নল ঘুরতে ঘুরতে কতকগুলি পাখি দেখতে পেলেন, তাদের পালক স্বর্ণবর্ণ। নল ভাবলেন, এই পাখিগুলিই আজ আমাদের ভক্ষ্য হবে আর তাদের পক্ষই ধন হবে। তিনি তাঁর পরিধানের বস্ত্র খুলে ফেলে পাখিদের উপর চাপা দিলেন। পাখিরা বস্ত্র নিয়ে আকাশে উঠে বললে, দুর্বুদ্ধি নল, যা নিয়ে দ্যূতক্রীড়া করেছিলে আমরাই সেই পাশা। তুমি সবস্ত্রে গেলে আমাদের প্রীতি হবে না। বিবদ্ধ নল দময়ন্তীকে বললেন, অনিন্দিতা, যাদের প্রকোপে আমি ঐশ্বর্যহীন হয়েছি, যাদের জন্য আমরা প্রাণযাত্রার উপযুক্ত খাদ্য আর নিষধবাসীর সাহায্য পাচ্ছি না তারাই পক্ষী হয়ে আমার বস্ত্র হরণ করেছে। আমি দুঃখে জ্ঞানহীন হয়েছি। আমি তোমার স্বামী, তোমার ভালর জন্য যা বলছি শোন।—এখান থেকে কতকগুলি পথ অবন্তী ও ঋক্ষবান পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গেছে। ওই বিন্ধ্য পর্বত, ওই পয়োষ্ণী নদী, ওখানে প্রচুর ফলমূল সমন্বিত ঋষিদের আশ্রম আছে। এই বিদর্ভ দেশের পথ, এই কোশল দেশের, ওই দক্ষিণাপথের। নল কাতর হয়ে এই সব কথা বার বার দময়ন্তীকে বললেন।

 দময়ন্তী বললেন, তোমার অভিপ্রায় অনুমান ক’রে আমার হৃদয় কাঁপছে, সর্বাঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে। তোমাকে ত্যাগ ক’রে আমি কি করে অন্যত্র যাব? ভিষকরা বলেন, সকল দুঃখে ভার্যার সমান ঔষধ নেই। নল বললেন, তুমি কেন আশঙ্কা করছ, আমি নিজেকে ত্যাগ করতে পারি কিন্তু তোমাকে পারি না। দময়ন্তী বললেন, মহারাজ, তবে বিদর্ভের পথ দেখাচ্ছ কেন? যদি আমার আত্মীয়দের কাছেই আমাকে পাঠাতে চাও তবে তুমিও চল না কেন? আমার পিতা বিদর্ভরাজ তোমাকে সসম্মানে আশ্রয় দেবেন, তুমি আমাদের গৃহে সুখে থাকতে পারবে। নল বললেন, পূর্বে সেখানে সমৃদ্ধ অবস্থায় গিয়েছিলাম, এখন নিঃস্ব হয়ে কি ক’রে যাব?

 নল-দময়ন্তী একই বস্ত্র পরিধান করে বিচরণ করতে করতে একটি পথিকদের বিশ্রামস্থানে এলেন এবং ভূতলে শয়ন করলেন। দময়ন্তী তখনই নিদ্রিত হলেন। নল ভাবলেন, দময়ন্তী আমার জন্যই দুঃখভোগ করছেন, আমি না থাকলে ইনি হয়তো পিতৃগৃহে যাবেন। কলির দুষ্ট প্রভাবে নল দময়ন্তীকে ত্যাগ করাই স্থির করলেন এবং যে বস্ত্র তাঁরা দু’জনেই পরে ছিলেন তা দ্বিখণ্ড করবার জন্য ব্যগ্র হলেন। নল দেখলেন, আশ্রয়স্থানের এক প্রান্তে একটি কোষমুক্ত খড়্‌গ রয়েছে। সেই খড়্‌গ দিয়ে বস্ত্রের অর্ধভাগ কেটে নিয়ে নিদ্রিতা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ ক’রে নল দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হলেন, কিন্তু আবার ফিরে এসে পত্নীকে দেখে বিলাপ করতে