পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭০
মহাভারত

লাগলেন। এইরূপে নল আন্দোলিতহহৃদয়ে বার বার ফিরে এসে অবশেষে প্রস্থান করলেন।

 নিদ্রা থেকে উঠে নলকে না দেখে দময়ন্তী শোকার্ত ও ভয়ার্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি পতির অন্বেষণে শ্বাপদসংকুল বনে প্রবেশ করলেন। সহসা কুম্ভীরের ন্যায় মহাকায় এক ক্ষুধার্ত অজগর তাঁকে ধরলে। দময়ন্তীর আর্তনাদ শুনে এক ব্যাধ তখনই সেখানে এল এবং তীক্ষ্ণ অস্ত্রে অজগরের মুখ চিরে দময়ন্তীকে উদ্ধার করলে। অজগরকে বধ ক’রে ব্যাধ দময়ন্তীকে প্রক্ষালনের জন্য জল এনে দিলে এবং আহারও দিলে। দময়ন্তী আহার করলে ব্যাধ বললে, মৃগশাবকাক্ষী, তুমি কে, কেন এখানে এসেছ? দময়ন্তী সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। অর্ধবসনধারিণী দময়ন্তীর রূপ দেখে ব্যাধ কামার্ত হয়ে তাঁকে ধরতে গেল। দময়ন্তী বললেন, যদি আমি নিষধরাজ ভিন্ন অন্য পুরুষকে মনে মনেও চিন্তা না করে থাকি তবে এই ক্ষুদ্র মৃগয়াজীবী গতাসু হয়ে প’ড়ে যাক। ব্যাধ তখনই প্রাণহীন হয়ে ভূপতিত হ’ল।

 দময়ন্তী ঝিল্লীনাদিত বহুবৃক্ষসমাকীর্ণ ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করলেন, সিংহ-ব্যাঘ্র-মহিষ-ভল্লুকাদি প্রাণী এবং ম্লেচ্ছ-তস্কর প্রভৃতি জাতি সেখানে বাস করে। তিনি উন্মত্তার ন্যায় শ্বাপদ পশু ও অচেতন পর্বতকে নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তিন অহোরাত্র উত্তর দিকে চ’লে তিনি এক রমণীয় তপোবনে উপস্থিত হলেন। তপস্বীরা বললেন, সর্বাঙ্গসুন্দরী, তুমি কে? শোক ক’রো না, আশ্বস্ত হও। তুমি কি এই অরণ্যের বা পর্বতের বা নদীর দেবী? দময়ন্তী তাঁর ইতিহাস জানিয়ে বললেন, ভগবান, যদি কয়েক দিনের মধ্যে নল রাজার দেখা না পাই তবে আমি দেহত্যাগ করব। তপস্বীরা বললেন, কল্যাণী, তোমার মঙ্গল হবে, আমরা দেখছি তুমি শীঘ্রই নিষধরাজের দর্শন পাবে। তিনি সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সর্বরত্নসমন্বিত হয়ে নিজ রাজ্য শাসন করবেন, শত্রুদের ভয় উৎপাদন ও সুহৃদ্‌গণের শোক নাশ করবেন। এই ব’লে তপস্বীগণ অন্তর্হিত হলেন। দময়ন্তী বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমি কি স্বপ্ন দেখলাম? তাপসগণ কোথায় গেলেন? তাঁদের আশ্রম, পুণ্যসলিলা নদী, ফলপুষ্পশোভিত বৃক্ষ প্রভৃতি কোথায় গেল?

 নলের অন্বেষণে আবার যেতে যেতে দময়ন্তী এক নদীতীরে এসে দেখলেন, এক বৃহৎ বণিকের দল অনেক হস্তী অশ্ব রথ নিয়ে নদী পার হচ্ছে। দময়ন্তী সেই যাত্রিদলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁর উম্মত্তের ন্যায় অর্ধবসনাবৃত কৃশ মলিন মূর্তি দেখে কতকগুলি লোক ভয়ে পালিয়ে গেল, কেউ অন্য লোককে ডাকতে গেল, কেউ হাসতে লাগল। একজন বললে, কল্যাণী, তুমি কি মানবী, দেবতা যক্ষী, না