পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বনপর্ব
১৭১

রাক্ষসী? আমরা তোমার শরণ নিলাম, আমাদের রক্ষা কর, যাতে এই বণিকের দল নিরাপদে যেতে পারে তা কর। দময়ন্তী তাঁর পরিচয় দিলেন এবং নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন শচি নামক সার্থবাহ (বণিক্‌সংঘের নায়ক) বললেন, যশস্বিনী, নলকে আমরা দেখি নি, এই বনে আপনি ভিন্ন কোনও মানুষও দেখি নি। আমরা বাণিজ্যের জন্য চেদিরাজ সুবাহুর রাজ্যে যাচ্ছি।

 নলের দেখা পাবেন এই আশায় দময়ন্তী সেই বণিকসংঘের সঙ্গে চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে সকলে এক বৃহৎ জলাশয়ের তীরে উপস্থিত হলেন। পরিশ্রান্ত বণিকের দল সেখানে রাত্রিযাপনের আয়োজন করলে। সকলে নিদ্রিত হ’লে অর্ধরাত্রে এক দল মদমত্ত বন্য হস্তী বণিক সংঘের পালিত হস্তীদের মারবার জন্য সবেগে এল। সহসা আক্রান্ত হয়ে বণিকরা ভয়ে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল, বন্য হস্তীর দন্তাঘাতে ও পদের পেষণে অনেকে নিহত হ’ল, বহু উষ্ট্র ও অশ্বও বিনষ্ট হ’ল। হতাবশিষ্ট বণিকরা বলতে লাগল, আমরা বাণিজ্যদেবতা মণিভদ্রের এবং যক্ষাধিপ কুবেরের পূজা করি নি তারই এই ফল। কয়েকজন বললে, সেই উন্মত্তদর্শনা বিকৃতরূপা নারীই মায়াবলে এই বিপদ ঘটিয়েছে। নিশ্চয় সে রাক্ষসী যক্ষী বা পিশাচী, তাকে দেখলে আমরা হত্যা করব।

 এই কথা শুনতে পেয়ে দময়ন্তী বেগে বনমধ্যে পলায়ন করলেন। তিনি বিলাপ ক’রে বললেন, এই নির্জন অরণ্যে যে জনসংঘে আশ্রয় পেয়েছিলাম তাও হস্তিযূথ এসে বিধ্বস্ত করলে, এও আমার মন্দভাগ্যের ফল। আমি স্বয়ংবরে ইন্দ্রাদি লোকপালগণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাঁদেরই কোপে আমার এই দুর্দশা হয়েছে। হতাবশিষ্ট লোকদের মধ্যে কয়েকজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন, দময়ন্তী তাঁদের সঙ্গে যেতে লাগলেন। বহুকাল পর্যটনের পর দময়ন্তী একদিন সায়াহ্ণকালে চেদিরাজ সুবাহুর নগরে উপস্থিত হলেন। তাঁকে উন্মত্তার ন্যায় দেখে গ্রাম্য বালকগণ কৌতূহলের বশে তাঁর অনুসরণ করতে লাগল। দময়ন্তী রাজগ্রাসাদের নিকটে এলে রাজমাতা তাঁকে দেখতে পেয়ে এক ধাত্রীকে বললেন, ওই দুঃখিনী শরণার্থিনী নারীকে লোকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি ওকে নিয়ে এস।

 দময়ন্তী এলে রাজমাতা বললেন, এই দুর্দশাতেও তোমাকে রূপবতী দেখছি, মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের ন্যায় তুমি কে? দময়ন্তী বললেন, আমি পতিব্রতা সদ্‌বংশীয়া সৈরিন্ধ্রী[১]। আমার ভর্তার গুণের সংখ্যা করা যায় না, কিন্তু

  1. যে নারী পরগৃহে স্বাধীনভাবে থেকে শিল্পাদির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে।