পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বনপর্ব
১৮৯

 ঋষ্যশৃঙ্গ মদনাবিষ্ট হয়ে অচেতনের ন্যায় শূন্যমনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরে বিভাণ্ডক মুনি আশ্রমে ফিরে এলেন। তাঁর চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, নখের অগ্রভাগ থেকে সমস্ত গাত্র রোমাবৃত। পুত্রকে বিহ্বল দেখে তিনি বললেন, বৎস, তোমাকে পূর্বের ন্যায় দেখছি না, তুমি চিন্তামগ্ন অচেতন ও কাতর হয়ে আছ কেন? কে এখানে এসেছিল? ঋষ্যশৃঙ্গ উত্তর দিলেন, একজন জটাধারী ব্রহ্মচারী এসেছিলেন, তিনি আকারে অধিক দীর্ঘ নন, খর্বও নন, তাঁর বর্ণ সুবর্ণের ন্যায়, চক্ষু পদ্মপলাশতুল্য আয়ত, তিনি দেবপুত্রের ন্যায় সুন্দর। তাঁর জটা দীর্ঘ, নির্মল কৃষ্ণবর্ণ, সুগন্ধ এবং স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত। আকাশে বিদ্যুতের ন্যায় তাঁর কণ্ঠে কি এক বস্তু দুলছে, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড আছে। তাঁর কটি পিপীলিকার মধ্যভাগের ন্যায় ক্ষীণ, পরিধেয় চীরবসনের ভিতরে সুবর্ণ মেখলা দেখা যাচ্ছিল। আমার এই জপমালার ন্যায় তাঁর চরণে ও হস্তে শব্দকারী আশ্চর্য মালা আছে। তাঁর পরিধেয় অতি অদ্ভুত, আমার চীরবসনের মতন নয়। তাঁর মুখ সুন্দর, কণ্ঠস্বর কোকিলের তুল্য, তাঁর বাক্য শুনলে আনন্দ হয়। তিনি তাঁর ডান হাত দিয়ে একটি গোলাকার ফলকে বার বার আঘাত করছিলেন, সেই ফলটি ভূমি থেকে লাফিয়ে উঠছিল। সেই দেবপুত্রের উপর আমার অত্যন্ত অনুরাগ হয়েছে, তিনি আমাকে আলিঙ্গন ক’রে আমার জটা ধরে মুখে মুখে ঠেকিয়ে একপ্রকার শব্দ করলেন, তাতে আমার হর্ষ হ’ল। তিনি যেসব ফল আমাকে খেতে দিয়েছিলেন তার ত্বক আর বীজ নেই, আমাদের আশ্রমের ফল তেমন নয়। তাঁর প্রদত্ত সুস্বাদু জল পান ক’রে আমার অত্যন্ত আনন্দ হ’ল, বোধ হল যেন পৃথিবী ঘুরছে। এইসকল বিচিত্র সুগন্ধ মালা তিনি ফেলে গেছেন, তাঁর বিরহে আমি অসুখী হয়েছি, আমার গাত্র যেন দগ্ধ হচ্ছে। পিতা, আমি তাঁর কাছে যেতে চাই, তাঁর ব্রহ্মচর্য কি প্রকার? আমি তাঁর সঙ্গেই তপস্যা করব।

 বিভাণ্ডক বললেন, ওরা রাক্ষস, অদ্ভুত রূপ ধারণ ক’রে তপস্যার বিঘ্ন জন্মায়, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও তপম্বীদের উচিত নয়। পুত্র, অসৎ লোকেই সুরাপান করে, মুনিদের তা পান করা অনুচিত, আর এই সকল মাল্যও আমাদের অব্যবহার্য।

 ওরা রাক্ষস, এই ব’লে পত্রকে নিবারণ ক’রে বিভাণ্ডক বেশ্যাকে খুঁজতে গেলেন, কিন্তু তিন দিনেও না পেয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। তার পর যখন তিনি ফল আহরণ করতে গেলেন তখন বেশ্যাকন্যা আবার আশ্রমে এল। ঋষ্যশৃঙ্গ হৃষ্ট ও ব্যস্ত হয়ে তাকে বললেন, আমার পিতা ফিরে আসবার আগেই আমরা আপনার আশ্রমে