পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০৪
মহাভারত

পদ্মটি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন, ভীমও ধনুর্বাণহস্তে পদ্মবনের সন্ধানে যাত্রা করলেন।

 ভীম মনোহর গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলেন এবং আনন্দিতমনে লতাসমূহ সঞ্চালিত ক’রে যেন খেলা করতে করতে চললেন। ভয়শূন্য হরিণের দল ঘাস মুখে ক’রে তাঁর দিকে সকৌতুকে চেয়ে রইল। যক্ষ ও গন্ধর্ব রমণীরা পতির পার্শ্বে ব’সে পরম রূপবান দীর্ঘকায় কাঞ্চনবর্ণ ভীমকে অদৃশ্যভাবে নানা ভঙ্গী সহকারে দেখতে লাগল। বনচর বরাহ মহিষ সিংহ ব্যাঘ্র শৃগাল প্রভৃতিকে সন্ত্রস্ত ক’রে চলতে চলতে ভীম গন্ধমাদনের সানুদেশে এক রমণীয় বিশাল কদলীবন দেখতে পেলেন। তিনি গর্জন ক’রে কদলীতরু উৎপাটিত করতে লাগলেন। সহস্র সহস্র জলচর পক্ষী ভয় পেয়ে আর্দ্রপক্ষে আকাশে উড়তে লাগল। তাদের অনুসরণ ক’রে তিনি পদ্ম ও উৎপল সমন্বিত একটি রমণীয় বিশাল সরোবরে উপস্থিত হলেন এবং উদ্দাম মহাগজের ন্যায় বহহৃক্ষণ জলক্রীড়া ক’রে তীরে উঠে তাল ঠুকে শঙ্খধ্বনি করলেন। সেই শব্দ শুনে পর্বতগুহায় সুপ্ত সিংহসকল গর্জন ক’রে উঠল এবং সিংহনাদে ত্রস্ত হয়ে হস্তীর দলও উচ্চ রব করতে লাগল।

 হনুমান সেখানে ছিলেন। ভ্রাতা ভীমসেন স্বর্গের পথে এসে পড়েছেন দেখে তাঁর প্রাণরক্ষার জন্য হনুমান কদলীতরুর মধ্যবর্তী পথ রুদ্ধ করলেন। সেই সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একজন চলতে পারে। হনুমান সেখানে শুয়ে প’ড়ে হাই তুলে তাঁর বিশাল লাঙ্গুল আস্ফোটন করতে লাগলেন, তার শব্দ পর্বতের গুহায় গৃহায় প্রতিধ্বনিত হ’ল। সেই শব্দ শুনে ভীমের রোমাঞ্চ হ’ল, তিনি নিকটে এসে দেখলেন, কদলীবনের মধ্যে এক বিশাল শিলার উপরে হনুমান শুয়ে আছেন, তিনি বিদ্যৎসম্পাতের ন্যায় দুর্নিরীক্ষ্য পিঙ্গলবর্ণ ও চঞ্চল। তাঁর গ্রীবা স্থূল ও খর্ব, কটিদেশ ক্ষীণ, ওষ্ঠদ্বয় হ্রস্ব, জিহ্বা ও মুখ তাম্রবর্ণ, ভ্রূ চঞ্চল, দন্ত শুক্ল ও তীক্ষ্ণ, তিনি স্বর্গের পথ রোধ ক’রে হিমাচলের ন্যায় বিরাজ করছেন। ভীম নির্ভয়ে হনুমানের কাছে গিয়ে ঘোর সিংহনাদ করলেন। মধুর ন্যায় পিঙ্গলবর্ণ চক্ষু ঈষৎ উন্মীলিত ক’রে হনুমান ভীমের দিকে অবজ্ঞাভরে চাইলেন এবং একটু হেসে বললেন, আমি রুগ্ন, সুখে নিদ্রামগ্ন ছিলাম, কেন আমাকে জাগালে? আমি তির্যগ্‌যোনি, ধর্ম জানি না, কিন্তু তুমি তো জান যে সকল প্রাণীকেই দয়া করা উচিত। তুমি কে, কোথায় যাবে? এই পথ দেবলোকে যাবার, মানুষের অগম্য।

 ভীম নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তুমি কে? হনুমান বললেন, আমি বানর, তোমাকে পথ ছেড়ে দেব না। ভাল চাও তো নিবৃত্ত হও, নতুবা তোমার মৃত্যু