পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বনপর্ব
২০৫

হবে। ভীম বললেন, মৃত্যুই হ’ক বা যাই হ’ক, তুমি ওঠ, পথ ছেড়ে দাও, তাহ’লে আমিও তোমার হানি করব না। হনুমান বললেন, আমি রুগ্ন, ওঠবার শক্তি নেই, যদি নিতান্তই যেতে চাও তো আমাকে ডিঙিয়ে যাও। ভীম বললেন, নির্গুণ পরমাত্মা দেহ ব্যাপ্ত ক’রে আছেন, তাঁকে অবজ্ঞা ক’রে আমি তোমাকে ডিঙিয়ে যেতে পারি না; নতুবা হনুমান যেমন সাগর লঙ্ঘন করেছিলেন সেইরূপ আমিও তোমাকে লঙ্ঘন করতাম। হনুমান বললেন, কে সেই হনুমান? ভীম বললেন, তিনি আমার ভ্রাতা, মহাগুণবান বুদ্ধিমান ও বলবান, রামায়ণোক্ত অতি বিখ্যাত বানরশ্রেষ্ঠ। আমি তাঁরই তুল্য বলশালী, তোমাকে নিগৃহীত করবার শক্তি আমার আছে। তুমি পথ দাও, নয়তো যমালয়ে যাবে। হনুমান বললেন, বার্ধক্যের জন্য আমার ওঠবার শক্তি নেই। তুমি দয়া কর, আমার লাঙ্গুলটি সরিয়ে গমন কর।

 বানরটাকে যমালয়ে পাঠাবেন স্থির করে ভীম তার পুচ্ছ ধরলেন, কিন্তু নড়াতে পারলেন না। তিনি দু হাত দিয়ে ধ’রে তোলবার চেষ্টা করলেন, তাঁর চক্ষু বিস্ফারিত হ’ল, ঘর্মস্রাব হ’তে লাগল, কিন্তু কোনও ফল হ’ল না। তখন তিনি অধোবদনে প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কপিশ্রেষ্ঠ, প্রসন্ন হ’ন, আমার কটুবাক্য ক্ষমা করুন। আমি শরণাপন্ন হয়ে শিষ্যের ন্যায় প্রশ্ন করছি — আপনি কে?

 হনুমান তখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, রাজ্যলাভের পর রাম আমাকে এই বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর কথা যত দিন জগতে প্রচলিত থাকবে তত দিন আমি জীবিত থাকব। সীতার বরে সর্বপ্রকার দিব্য ভোগ্যবস্তু আমি ইচ্ছা করলেই উপস্থিত হয়। কুরুনন্দন, এই দেবপথ মানুষের অগম্য সেজন্যই আমি রোধ করেছিলাম। তুমি যে পদ্মের সন্ধানে এসেছ তার সরোবর নিকটেই আছে। ভীম হৃষ্ট হয়ে বললেন, আমার চেয়ে ধন্যতর কেউ নেই, কারণ আপনার দর্শন পেয়েছি। বীর, সমুদ্রলঙ্ঘনের সময় আপনার যে রূপ ছিল তাই দেখিয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন। হনুমান ভীমের প্রার্থনা পূরণ করলেন, তাঁর সেই আশ্চর্য ভীষণ বিন্ধ্যপর্বততুল্য দেহ দেখে ভীম রোমাঞ্চিত হয়ে বললেন, প্রভু, আপনার বিপুল শরীর দেখলাম, এখন সংকুচিত করুন। আপনি পার্শ্বে থাকতে রাম স্বয়ং কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন? আপনি তো নিজের বাহুবলেই রাবণকে সদলবলে ধ্বংস করতে পারতেন। হনুমান বললেন, তোমার কথা যথার্থ, রাবণ আমার সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু আমি তাঁকে বধ করলে রামের কীর্তি নষ্ট হ’ত। ভীম, এই পদ্মবনে যাবার পথ, এখান দিয়ে গেলে তুমি কুবেরের উদ্যান দেখতে পাবে, কিন্তু তুমি বলপ্রয়োগ ক’রে পুষ্পচয়ন ক’রো না।