পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৪
মহাভারত

 একদিন ভীমসেন মৃগ বরাহ মহিষ বধ ক’রে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় এক পর্বতকন্দরবাসী হরিদ্‌বর্ণ চিত্রিতদেহ মহাকায় সর্প তাঁকে বেষ্টন ক’রে ধরলে। অজগরের স্পর্শে ভীমের সংজ্ঞালোপ হ’ল, মহাবলশালী হয়েও তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। ভীম বললেন, ভুজগশ্রেষ্ঠ, তুমি কে? আমি ধর্মরাজের ভ্রাতা ভীমসেন, অযুত হস্তীর সমান বলবান, আমাকে কি করে বশে আনলে? ভীমের দুই বাহু মুক্ত এবং তাঁর দেহ বেষ্টিত ক’রে অজগর বললে, তোমার পূর্বপুরুষ রাজর্ষি নহুষের নাম শুনে থাকবে, আমি সেই নহুষ[১] অগস্ত্যের শাপে সর্প হয়েছি। আমি বহুকাল ক্ষুধার্ত হয়ে আছি, আজ ভাগ্যক্রমে তোমাকে ভক্ষ্যরূপে পেয়েছি। ভীম বললেন, নিজের প্রাণের জন্য আমি ভাবছি না, আমার মৃত্যু হ’লে আমার ভ্রাতারা শোকে বিহ্বল ও নিরূদ্যম হবেন। রাজ্যের লোভে আমি ধর্মপরায়ণ অগ্রজকে কটুকথা বলে পীড়া দিয়েছি। আমার মৃত্যুতে হয়তো সর্বাস্ত্রবিৎ ধীমান অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হবেন না, কিন্তু মাতা কুন্তী ও নকুল-সহদেব অত্যন্ত শোক পাবেন।


 সহসা নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখে যুধিষ্ঠির ভীত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায়। দ্রৌপদী বললেন, তিনি বহুক্ষণ পূর্বে মৃগয়া করতে গেছেন। যুধিষ্ঠির ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে ভীমের অন্বেষণে চললেন। মৃগয়ার চিহ্ন অনুসরণ করে তিনি এক পর্বতকন্দরে এসে দেখলেন, এক মহাকায় সর্প ভীমকে বেষ্টন ক’রে রয়েছে, তাঁর নড়বার শক্তি নেই। ভীমের কাছে সব কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, অমিতবিক্রম সর্প, আমার ভ্রাতাকে ছেড়ে দিন, আপনাকে অন্য ভক্ষ্য দেব। সর্প বললে, এই রাজপুত্রকে আমি মুখের কাছে পেয়েছি, এই আমার ভক্ষ্য। তুমি চ’লে যাও, নয়তো কাল তোমাকেও খাব। কিন্তু তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পার তবে তোমার ভ্রাতাকে ছেড়ে দেব। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি ইচ্ছামত প্রশ্ন করুন, আমি তার উত্তর দেব।

 সর্প বললে, তোমার বাক্য শুনে মনে হচ্ছে তুমি অতি বুদ্ধিমান। বল—ব্রাহ্মণ কে? জ্ঞাতব্য কি? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, সত্য দান ক্ষমা সচ্চরিত্র অহিংসা তপস্যা ও দয়া যাঁর আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। সুখদুঃখহীন পরব্রহ্ম, যাঁকে লাভ করলে শোক থাকে না, তিনিই জ্ঞাতব্য। সর্প বললে, শূদ্রদের মধ্যেও তো ওইসব


  1. নহুষের পূর্বকথা উদ্‌যোগপর্ব ৪-পরিচ্ছেদে আছে।