পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৮
মহাভারত

সেবক, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। আপনি সেই ধর্মব্যাধের কাছে যান, তিনি আপনাকে ধর্মশিক্ষা দেবেন। আমার বাচালতা ক্ষমা করুন, স্ত্রী সকলেরই অবধ্য।

 কৌশিক বললেন, শোভনা, আমি প্রীত হয়েছি, আমার ক্রোধ দূর হয়েছে, তোমার ভর্ৎসনায় আমার মঙ্গল হবে। তার পর কৌশিক জনকরাজার পুরী মিথিলায় গেলেন এবং ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা ক’রে ধর্মব্যাধের নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মব্যাধ তখন তাঁর বিপণিতে ব’সে মৃগ ও মহিষের মাংস বিক্রয় করছেন, বহু ক্রেতা সেখানে এসেছে। কৌশিককে দেখে ধর্মব্যাধ সসম্ভ্রমে অভিবাদন ক’রে বললেন, এক পতিব্রতা নারী আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন তা আমি জানি। এই স্থান আপনার যোগ্য নয়, আমার গৃহে চলুন। ধর্মব্যাধের গৃহে গিয়ে কৌশিক বললেন, বৎস, তুমি যে ঘোর কর্ম কর তা তোমার যোগ্য নয়। ধর্মব্যাধ বললেন, আমি আমার কুলোচিত কর্মই করি। আমি বিধাতার বিহিত ধর্ম পালন করি, বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করি, সত্য বলি, অসূয়া করি না, যথাশক্তি দান করি, দেবতা অতিথি ও ভৃত্যদের ভোজনের পর অবশিষ্ট অন্ন খাই। আমি নিজে প্রাণিবধ করি না, অন্যে যে বরাহ-মহিষ মারে আমি তাই বেচি। আমি মাংস খাই না, কেবল ঋতুকালে ভার্যার সহবাস করি, দিনে উপবাসী থেকে রাত্রে ভোজন করি। আমার বৃত্তি অতি দারুণ, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দৈবকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য, আমি পূর্বকৃত কর্মের ফল ভোগ করছি। মাংসে দেবতা পিতৃগণ অতিথি ও পরিজনের সেবা হয়, সেজন্য নিহত পশুরও ধর্ম হয়। শ্রুতিতে আছে, অম্লের ন্যায় ওষধি লতা পশু পক্ষীও মানুষের খাদ্য। রাজা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রত্যহ দু হাজার গরু পাক হ’ত। যথাবিধানে মাংস খেলে পাপ হয় না। ধান্যাদি শস্যবীজও জীব, প্রাণী পরস্পরকে ভক্ষণ ক’রেই জীবিত থাকে, মানুষ চলবার সময় ভূমিস্থিত বহু প্রাণী বধ করে। জগতে অহিংসক কেউ নেই।

 তার পর ধর্ম, দর্শন ও মোক্ষ সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিয়ে ধর্মব্যাধ বললেন, যে ধর্ম দ্বারা আমি সিদ্ধিলাভ করেছি তা আপনি প্রত্যক্ষ করুন। এই ব’লে তিনি কৌশিককে এক মনোরম সৌধে নিয়ে গেলেন, সেখানে ধর্মব্যাধের মাতা-পিতা আহারের পর শুক্ল বসন ধারণ করে সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তম আসনে ব’সে আছেন। ধর্মব্যাধ মাতা-পিতার চরণে মস্তক রাখলে তাঁরা বললেন, পুত্র, ওঠ ওঠ, ধর্ম তোমাকে রক্ষা করুন। ধর্মব্যাধ কৌশিককে বললেন, এঁরাই আমার পরমদেবতা, ইন্দ্রাদি তেত্রিশ দেবতার সমান। আপনি নিজের মাতা-পিতাকে অবজ্ঞা করে তাঁদের অনুমতি না নিয়ে বেদাধ্যয়নের জন্য গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন।